শ্রীশৈল বাংলাদেশের সিলেট শহরের ৩ কি.মি. উত্তর-পূর্বে দক্ষিণ সুরমা জৈনপুর গ্রামে অবস্থিত একটি শক্তিপীঠ। এখানে সতী দেবীর গ্রীবা (গন্ডদেশের পেছন দিক) পতিত হয়েছিল। এখানে দেবী মহালক্ষ্মী ও ভৈরব সর্বানন্দ।
শক্তিপীঠ
শক্তিপীঠ হিন্দুধর্মের পবিত্রতম তীর্থগুলির অন্যতম। লোকবিশ্বাস অনুসারে, শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলিতে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর দেহের নানান অঙ্গ প্রস্তরীভূত অবস্থায় রক্ষিত আছে। সাধারণত ৫১টি শক্তিপীঠের কথা বলা হয়ে থাকলেও, শাস্ত্রভেদে পীঠের সংখ্যা ও অবস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। পীঠনির্ণয় তন্ত্র গ্রন্থে শক্তিপীঠের সংখ্যা ৫১। শিবচরিত গ্রন্থে ৫১টি শক্তিপীঠের পাশাপাশি ২৬টি উপপীঠের কথাও বলা হয়েছে। কুব্জিকাতন্ত্র গ্রন্থে এই সংখ্যা ৪২। আবার জ্ঞানার্ণবতন্ত্র গ্রন্থে পীঠের সংখ্যা ৫০। ভারতীয় উপমহাদেশের নানা স্থানে এই শক্তিপীঠগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সকল শক্তিপীঠসমূহে শক্তিদেবী ভৈরবের সাথে অবস্থান করেন।
পৌরাণিক কাহিনী
কিংবদন্তি অনুসারে, সত্য যুগের কোনও এক সময়ে মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার শশুর দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। কন্যা সতী দেবী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘যোগী’ মহাদেবকে বিবাহ করায় দক্ষ ক্ষুব্ধ ছিলেন। মহাদেব ও সতী দেবী ছাড়া প্রায় সকল দেব-দেবীকে দক্ষ নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী দেবী মহাদেবের অনুসারীদের সাথে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন।
কিন্তু সতী দেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। অধিকন্তু দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন। সতী দেবী তার স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন।
এ খবর শুনে শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষর যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। জগৎ সংসার ধ্বংস হবার উপক্রম হয়। অন্যান্য দেবতা অনুরোধ করে এই নৃত্য থামান এবং বিষ্ণুদেব তার সুদর্শন চক্র দ্বারা সতী দেবীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখণ্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং পবিত্র পীঠস্থান (শক্তিপীঠ) হিসেবে পরিচিতি পায়।
ইতিহাস
কথিত এই যে, দেবীর গ্রীবার পতন হয়েছিল একটি শিলার ওপর, এই শিলাই পূজিতা হতেন আদিকাল থেকে। এই পীঠ বহুকাল গুপ্ত ছিল। বাংলার দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মাঝে এখানে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছিল। সে সময় দেবীপ্রসাদ দাশ নামক এক ব্যক্তি রাস্তার কাজের জন্য কিছু শ্রমিককে নিযুক্ত করেন। রাস্তা মেরামতের সময় মাটি খুড়লে একটি কালো শিলা বের হয়ে আসে। কিছুতেই সেই শিলাকে সড়ানো যাচ্ছিলো না। এক শ্রমিক শাবল দিয়ে শিলাকে দুখণ্ড করে দিলো এবং সাথে সাথে পাশের জঙ্গল থেকে একটি বালিকা বের হয়ে সেই শ্রমিক কে চড় মারলো এবং সকলকে হতবাক করে নিমিষে সেই বালিকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সেই রাত্রে দেবীপ্রসাদকে মা মহালক্ষ্মী স্বপ্নাদেশ দিয়ে বললেন –তুই এই স্থানে আমাকে প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পূজোর ব্যবস্থা কর।
ধনী দেবীপ্রসাদ লক্ষ ইট দিয়ে দেবীর মন্দির তৈরির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু পরদিন রাতেই আবার স্বপ্নাদেশ পেলেন –আমি বদ্ধ থাকতে চাইনা, আমার মন্দির নির্মাণের প্রয়োজন নেই, আমাকে তুই উন্মুক্ত অবস্থায় রাখিস, আমি উন্মুক্ত অবস্থাতেই পূজিত হতে চাই।
দেবীর আদেশাক্রমে দেবীপ্রসাদ সেইরকম ব্যবস্থা করলেন।
দেবীর মতোই ভৈরব সর্বানন্দ প্রথমে অজ্ঞাত ছিলেন। একদিন এক মহান সাধক ব্রহ্মানন্দ গিরি শ্রীহট্টে আসলেন এবং দেবীর সাধনাতে সিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই সাধক সাধনাবলে জানতে পারলেন, দেবী মহালক্ষ্মীর পশ্চিমদিকে রয়েছে একটি টিলা এবং সেই টিলার মধ্যেই ভগবান শিব আছেন। একদিন গভীর রাতে সেই সাধক তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সেই টিলায় উঠে জানালেন, এই স্থানেই দেবীর ভৈরব আছেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১২৮১ বঙ্গাব্দে সেই ভৈরব উদ্ধার করার আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন। আচার্য শঙ্করের দশনামী সম্প্রদায়ের সাধক ব্রহ্মানন্দ গিরির এক শিষ্য ছিল, তিনিও বড় সাধক ছিলেন। তাঁর নাম ছিলো বিরজানাথ ন্যায়বাগীশ, ১২৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে তিনি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে তিনি দেখলেন তাঁর গুরুদেব ব্রহ্মানন্দ গিরি দুজন শিষ্যকে নিয়ে সেই শিবটিলায় উঠে বলছেন –এখানে দেবীর ভৈরব আছেন, আমি তাঁকে প্রকাশ করবো।
মাটি খুঁড়ে শিবলিঙ্গটি দেখতে পেলেন। স্বপ্নভঙ্গহতেই বিরজানাথ দেখতে পেলেন তাঁর দুজন শিষ্য কৈলাসচন্দ্র ভট্টাচার্য ও কৃষ্ণকুমার ভট্টাচার্য বাড়ীতে এসেছেন। অলৌকিকভাবে তাঁরা দুইজনেও একই স্বপ্ন দেখেছেন এবং দুই শিষ্যই গুরুদেবকে স্বপ্নটি বৃতান্ত বললেন। গুরুদেব বিরজানাথ যখন বুঝলেন তারা তিনজনই একই রাত্রে একই স্বপ্ন দেখেছেন, তখন কালবিলম্ব না করেই গুরুদেব বিরজানাথ দুই শিষ্য সমেত সেই টিলায় উঠে মাটি খনন করতেই গৌরীপট্টসহিত শিবলিঙ্গ উঠে আসলো। এভাবে দেবীর ভৈরব প্রকট হলেন ।
মূর্তি
তন্ত্র মতে – “গ্রীবা পপাত শ্রীহট্টে সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী। দেবীতত্র মহালক্ষ্মী সর্বনন্দশ্চ ভৈরব।।”
এখানে সতী দেবীর গ্রীবা (গন্ডদেশের পেছন দিক) পতিত হয়েছিল। ফলে উক্ত স্থানটি “গ্রীবামহাপীঠ” নামে পরিচিতি লাভ করে। দেবী এখানে মহালক্ষ্মী হিসেবে পূজিত হন এবং অনতিদূরে ঈশান কোণে গোটাটিকর গ্রামে “সর্বানন্দ ভৈরব” নামে পীঠরক্ষী শিব মন্দির অবস্থিত।
গুগল ম্যাপে লোকেশান
সূত্র: উইকিপিডিয়া
তারিখ ২৭.০১.২০২২