বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য ভারতের আসলে কতদূর কী করার আছে?

বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য ভারতের আসলে কতদূর কী করার আছে?

গত চার মাসে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নির্যাতন বন্ধে ভারত জোরালোভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র পর্যন্ত একাধিকবার এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ করেছেন। ভারতীয় সংসদে এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন সংগঠন সীমান্তে বিক্ষোভ দেখিয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ডাউনগ্রেডের পরামর্শ দিচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমস্যার সমাধান কেবলমাত্র কূটনৈতিক পথেই সম্ভব। (সূত্রঃ বিবিসি)

ঢাকা, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪: গত সাড়ে চার মাসে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বন্ধে ভারত একাধিকবার কূটনৈতিকভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ভারতের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে এই বিষয়টি তুলেছেন। নরেন্দ্র মোদী একাধিকবার সরাসরি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে টেলিফোনে ও সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন। এছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিবরা নিউ ইয়র্ক ও ঢাকায় বৈঠকে এই প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। এমনকি ভারতীয় সংসদেও বাংলাদেশে হিন্দুদের দুর্দশা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টি ভারতের সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্র এই বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের অভিযোগকে অতিরঞ্জিত বা ভুয়া বলে নাকচ করেছে। যদিও ভারতের অভ্যন্তরে এই সংবাদ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এবং জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ছাড়াও গুজরাট, রাজস্থান এবং তামিলনাড়ুর মতো দূরবর্তী রাজ্যগুলোতেও বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে।

ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং বিরোধী দল কংগ্রেস, উভয়েই এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সমানভাবে সরব হয়েছে। সম্প্রতি পার্লামেন্টে বিরলভাবে এই দুই দল একসাথে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছে। সেপ্টেম্বরের শেষে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভারত সফরে আসে, তখন বিভিন্ন সংগঠন দাবি জানায় যে, হিন্দু নির্যাতন চলতে থাকলে ভারতের উচিত বাংলাদেশ দলের সাথে সিরিজ বয়কট করা। এমন পদক্ষেপ আগে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা গেলেও, বাংলাদেশ নিয়ে এই ধরনের হুঁশিয়ারি ছিল প্রথম।

বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা হিন্দুদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি উঠেছে ভারতের বিভিন্ন সংগঠন থেকে। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীও এই দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং সীমান্ত অবরোধের কর্মসূচি পালন করেছেন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নেপালের সংবিধান ইস্যুতে ভারতের অর্থনৈতিক অবরোধের মতো বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। তবে অন্যরা মনে করেন, বাংলাদেশ নেপালের মতো স্থলবেষ্টিত নয়, তারা সমুদ্রপথে সরবরাহ চালিয়ে যেতে পারবে।

ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদ রীভা গাঙ্গুলি দাশ মনে করেন, এই সংকটের সমাধান কেবল কূটনৈতিক পথেই সম্ভব। তিনি বলেন, ২০০১ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, যা বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর ছিল। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রকে ঢাকায় পাঠান এবং বাংলাদেশের সরকারকে কড়া বার্তা দেন। এর ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তিনি বলেন, আজকের পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের মাটিতেই তাদের সুরক্ষিত রাখতে হবে।

রাজনীতিবিদ তথাগত রায়ের মতে, ভারতের কাছে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন উপায় খোলা আছে। তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক ডাউনগ্রেড, বিমান চলাচল সীমিত করা, বাংলাদেশি গার্মেন্ট খাতের কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ এবং নদীর পানি আটকে দেওয়ার মতো পদক্ষেপের পরামর্শ দেন। তবে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় রাখতে হবে।

অধ্যাপক বলদাস ঘোষাল মনে করেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা এবং এর সমাধান দ্রুত সম্ভব নয়। ভারত যদি সরাসরি কঠোর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভারতের উচিত পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাপানের মতো দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

সবশেষে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ভারতকে ধৈর্য ধরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা ভারতের নিজস্ব স্বার্থের বিষয় এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই।

তারিখ: ২২.১২.২০২৪