সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘু ও নারীর প্রতিনিধিত্বের অভাব

সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘু ও নারীর প্রতিনিধিত্বের অভাব

সংবিধান, বিচার বিভাগসহ ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নারীর প্রতিনিধিত্বের অভাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। মোট ৫০ সদস্যের মধ্যে প্রাক্তন আমলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাধান্য রয়েছে; তবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নেই এবং নারী সদস্যের সংখ্যা অত্যন্ত কম। অংশীজন ও নাগরিক সমাজ এই প্রতিনিধিত্বের অভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি পূরণে বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। উপদেষ্টারা এ বিষয়ে জনমতের প্রতিফলন ঘটার আশ্বাস দিয়েছেন।

ঢাকা, ২৪ অক্টোবর ২০২৪: সংবিধান, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনে পর্যাপ্ত প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন অংশীজন ও নাগরিক সমাজ। এসব কমিশনে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং নারীর প্রতিনিধিত্ব সীমিত, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গভাবে ঘোষিত ছয়টি কমিশনে মোট ৫০ জন সদস্যের মধ্যে প্রাক্তন আমলা রয়েছেন ১৫ জন, প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা দুইজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আটজন, বিচারপতি ও বিচারক পাঁচজন, আইনজীবী ছয়জন, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ছয়জন এবং অন্যান্য পেশাজীবী আটজন। তবে নারী সদস্য মাত্র পাঁচজন এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ছয়জনের মধ্যে একজনের নামই শুধু প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া, চারটি কমিশনে প্রধানদের নাম ঘোষিত হলেও, সেখানে একজন মাত্র নারী আছেন এবং তিনি শুধুমাত্র নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। ১৩ অক্টোবর তাঁর ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “সংস্কার কমিশনে আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি অনুপস্থিত বা অপর্যাপ্ত। এতে নোবেলজয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।” প্রথম আলোকে তিনি আরও জানান, প্রাথমিকভাবে তাঁকে কমিশনে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা বাতিল করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করতে কমিশন গঠন করেছে। সেইসঙ্গে, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, নারী এবং শ্রম বিষয়েও সংস্কারের সুপারিশের জন্য চারটি কমিশন গঠন করা হয় এবং প্রধানদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বাকি সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হবে।

নাগরিক সমাজ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিশনগুলোতে ঢাকার শিক্ষকদের প্রাধান্য বেশি; বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পাঁচজন শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা কমিশনগুলোতে প্রতিফলিত হয়নি।

এ বিষয়ে প্রথম আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টা বলেন, “কমিশনগুলোতে সবার মতামতের প্রতিফলন ঘটানো হবে। তাই তাদের সুপারিশ বা প্রস্তাবে বিভিন্ন পক্ষের মতামত অন্তর্ভুক্ত থাকবে।” জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনেও সমালোচনা এসেছে, যেখানে সাত সদস্যের মধ্যে ছয়জনই প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এবং অন্যান্য ২৫টি ক্যাডারের কেউই অন্তর্ভুক্ত নেই।

সংবিধান সংস্কার কমিশন, যা ছয়টি কমিশনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাতে ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুর কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। এ বিষয়ে দেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগ মুসলমান হলেও, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকে।

সংস্কার কমিশনগুলোতে প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন মন্তব্য করেন যে, “কমিশনগুলোতে নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি কম থাকলেও এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সংস্কারের প্রস্তাব তৈরিতে সমাজের সকল পক্ষের স্বার্থ বিবেচনা করা হবে।”

অন্যদিকে, টাস্কফোর্সেও ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি নেই, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, “গণ-অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলা হচ্ছে; কমিশনগুলোতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা হওয়া উচিত।”

তারিখ: ১০.১১.২০২৪