গত ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক হামলার ঘটনা ঘটে। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সদস্যদেরও আক্রমণের শিকার হতে হয়। এই সময় বিভিন্ন সংখ্যালঘু ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা অনেকের জীবনে অসহনীয় কষ্ট বয়ে এনেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়কে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এই ধরনের সহিংসতা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামোকে আরো দুর্বল করছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের এসব ঘটনায় রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা ও সহিংসতার মূল কারণগুলোর গভীরতর বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে।
ঢাকা, ০৬ নভেম্বর ২০২৪: গত ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে যে অস্থিরতা দেখা দেয়, তার মধ্যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও নানা আক্রমণের শিকার হয়। এই হামলার ঘটনাগুলো বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জনরোষ, এবং ব্যক্তিগত আক্রোশকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা ঘটে। দেশব্যাপী এই সহিংসতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ১,০৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আক্রমণ হয়। এই সহিংস ঘটনায় দুজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময়ও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল, যখন দেশের ২৭টি জেলায় মন্দির ও পূজামণ্ডপে ভাঙচুর, দোকান ও ঘরবাড়িতে আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ওই সময় মৃতের সংখ্যা ছিল আরও বেশি।
এই সহিংসতার প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বা সামাজিক সুবিধা লাভের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটানো হয়। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বা তাদের রক্ষাকারী হিসেবে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে কিছু রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী নেতা এই হামলাকে পুঁজি করে নিজেদের সুবিধা লাভে সক্রিয় হয়। অনেক সময় জমি বা সম্পত্তির দখল নিতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে, যা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে আরও উসকে দেয়।
ইন্টারন্যাশনাল গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালী নেতারা তরুণদেরকে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিভিন্নভাবে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। যেমন, ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিভেদের প্রবণতা নির্বাচনের আগে বাড়তে দেখা যায়। বাংলাদেশেও এই ধরনের হামলার মূল কারণগুলো একই ধরনের রাজনীতিক চালচিত্রে ঘেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানোর জন্য সামাজিক ও সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত আশুতোষ ভার্শ্নের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নাগরিক সংগঠনগুলো ‘বিশ্বাস সংযোগ’ তৈরির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আস্থা বাড়াতে পারে, যা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার হার কমাতে সহায়ক হতে পারে।
এদিকে, গণ–অভ্যুত্থানের পর ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সংখ্যালঘু নির্যাতনকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন পুরোনো ভিডিও ও ছবি ব্যবহার করে হিন্দুদের ওপর হামলাকে আরো প্রকট করে তোলা হয়। এসব প্রচারণার ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। গণ–অভ্যুত্থানের সময় অনেক সংখ্যালঘুও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের আশায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এই অস্থির সময়ে ৯ জন হিন্দুধর্মাবলম্বী গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ হন। তাঁদের আত্মত্যাগ সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়, যেখানে সব ধর্মের মানুষ সাম্য ও স্বাধীনতায় বসবাস করতে পারবে।
দেশে জাতিগত সহিংসতা ও ধর্মীয় বিভেদ কমানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছ অবস্থান নেওয়া এবং সমাজে অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
সাইমুম পারভেজ : ডয়চে ভেলে একাডেমির রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক প্রভাষক
তারিখ: ১০.১১.২০২৪