আর কত সইতে হবে নির্যাতন

আর কত সইতে হবে নির্যাতন

বাংলাদেশে সম্প্রতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ বেড়েছে, হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং পুজো মণ্ডপে হামলার খবর এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অত্যাচারের মতোই, বর্তমান পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চিহ্নিতকরণ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

ঢাকা, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪: মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আজব ছেলে’ গল্পের একটি দৃশ্যের মধ্যে, এক ব্যক্তি এক যুবককে ভুল করে তার গাড়িতে তুলে নেন এবং প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে থাকেন, কারণ ওই যুবক খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং ‘ইন্ডিয়া’র উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাচ্ছে এমন সন্দেহ জেগেছিল। কিন্তু যুবকটি জানান, তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করে এই পথটুকু খালি পায়ে হেঁটে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং সে তার মায়ের কষ্ট বুঝে একইভাবে সেই পথটি হাঁটতে চায়। গল্পটি বাস্তবের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে, যেখানে বর্তমান পরিস্থিতি এবং অতীতের ক্ষতগুলো একইভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষত, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন এবং তাদের দোকান লুট করার ঘটনা বেশ নিয়মিত হয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাসে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, চাকরি থেকে অব্যাহতি, এবং সামাজিকভাবে নিঃশেষ করার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। তাদের ওপর বিশেষত ‘ভারতে পাঠানোর’ স্লোগান শোনা যাচ্ছে এবং মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে ভারতীয় নাগরিকদের সাথে যোগাযোগ করার অভিযোগ উঠছে।

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম এবং অন্যান্য জায়গায় বসবাসরত তাদের আত্মীয়দের সম্পর্ক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি একটি নতুন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে, যেখানে বহু বাংলাদেশি পরিবার এবং ভারতীয় পরিবার একে অপরের আত্মীয়। তবে এই সম্পর্কের কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের মাত্রা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে, এসব আক্রমণকে রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যেখানে, যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন, তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল, তা একটি ইতিহাসের অংশ। তবে সেই সময়ের পর, বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির পেছনে দাঁড়িয়ে যে নতুন দেশটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে ধর্মনির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন সেই আশা অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর, সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে—এই ধারণা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।

দুই বছর আগের কুমিল্লার ঘটনায় যখন দুর্গাপূজার প্রতিমা ধ্বংস হয়েছিল এবং অনেক মন্দিরে হামলা হয়েছিল, তখনও প্রতিরোধের আলো দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। এবার এই আক্রমণের উদ্দেশ্য আরও সুপরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছে। আক্রমণের অজুহাত হিসেবে রাজনৈতিক অবস্থানকে সামনে আনা হচ্ছে এবং ইসকনসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির ওপর আক্রমণ বেড়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা অনেকটা মায়ানমার বা হরিয়ানার মতো ঘটনার মতো। সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে এবং তাদের জীবনকে বিপন্ন করা হচ্ছে। এসব ঘটনা মূলত একটি সংকেত দেয়, যা গভীরভাবে শঙ্কা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে বহু বছরের পুরনো সুফি মাজার, সাংস্কৃতিক চিহ্ন এবং ধর্মীয় স্থাপনার ওপর আক্রমণ চলছে, যা বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য এক অশনি সংকেত।

রাজনৈতিক পালাবদলের পর, প্রথম দু’সপ্তাহের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ শুরু হয়েছিল এবং এখন সেই আক্রমণ আরও বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের পাশাপাশি, অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, এক নতুন রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সংকটের মুখে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়, অনেককে একজোট হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু এখন সেই ঐক্য এবং সমানাধিকার সংকটে পড়েছে। বিশেষত, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং তার সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন, প্রথাগত চিহ্ন ধ্বংস, এবং সাম্প্রতিক সময়ের ধর্মীয় আক্রমণ এ সবই দেশের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সময়ের পরিস্থিতি বেদনাদায়ক। কেবলমাত্র রাজনৈতিক পালাবদলের সময় নয়, এক বিপদজনক মুহূর্তে, বাংলাদেশ একটি সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে।

তারিখ: ৩০.১১.২০২৪