সংখ্যালঘু ‘ভোট ব্যাংক’ রাজনীতির সমাধান কোন পথে

সংখ্যালঘু ‘ভোট ব্যাংক’ রাজনীতির সমাধান কোন পথে

ভারত ও বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে শুরু হওয়া ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি একদিকে যেমন জাতিগত বিভাজন সৃষ্টি করেছিল, অন্যদিকে একে অপরকে অপবিত্র মনে করার মনোভাবও ছড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিস্থিতি এখনও পরিবর্তন হয়নি, বরং রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় ভোট ব্যাংক ব্যবহারের ঘটনা চলছেই। এই সংঘর্ষের পেছনে একাধিক রাজনৈতিক ইস্যু ও জনমত বিভাজনের দোষ রয়েছে, যা সমাজের মধ্যে বিরোধিতার সৃষ্টি করে।

ঢাকা, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪: এ অঞ্চলের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া এবং সংঘর্ষের পটভূমি অনেক পুরনো। অনেকেই মনে করেন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি প্রয়োগ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষতি করেছে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ব্রিটিশরা ভারতকে একত্রিত করে, কিন্তু যাওয়ার সময় তারা দেশটি ভাগ করে দেয়। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পেছনে দেশের এই বিভাজন ছিল প্রধান কারণ।

এটিকে আরো ভালোভাবে বুঝতে চাইলে, আমাদের অতীতে ফিরে তাকাতে হয়। এগারো শতকে, ভারততত্ত্ববিদ আল বিরুনির চোখে, মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পর্কে কিছুটা বৈরী মনোভাব পোষণ করত। তিনি বলেন, মুসলমানরা হিন্দুদের পোশাক, জীবনযাত্রা এবং নিয়মকানুন সম্পর্কে তাদের সন্তানদের বাজে ধারণা দিত এবং তাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক অভ্যাসকে অপবিত্র মনে করত। এতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল, যা পরবর্তীতে বিশাল পার্থক্য তৈরি করেছিল।

ভারত ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভারত হিন্দুদের রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও ভারতকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করা হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি। দেশভাগের পর, ভারত বা পাকিস্তানে কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছিল, যা কখনও থামেনি।

১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে ধর্মীয় এবং জাতিগত বিভাজন ছিল। মুসলমানরা মুসলমানদের ভোট দিয়েছিল এবং হিন্দুরা হিন্দুদের ভোট দিয়েছিল। কিন্তু, ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং অমুসলিমদের জন্য দলের দরজা খোলা হয়। এই সময়েই যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা চালু করা হয়, যা ভারতে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন এনে দেয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭১ সালে মুসলমানদের রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংযোজন ছিল, কিন্তু তা কখনই বাস্তবে পরিণত হয়নি। আওয়ামী লীগ, যদিও সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা রেখেছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রম কখনও একেবারে নিরপেক্ষ ছিল না। হিন্দুদেরকে ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চলে।

এরপর ১৯৯৬ সালে বিএনপি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে গিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রহণ করে এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে একাধিক ঘটনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উসকানি দেওয়ার ঘটনা ঘটে, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাড়ে। রামু, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী এবং অন্যান্য জায়গায় মন্দিরে হামলা এবং প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকেরা জড়িত ছিল এবং তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বার্তা দিতে চায় যে দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুটি দল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, নিজেদের ভোট ব্যাংক কায়েম রাখতে ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট আদায় করেছে। আওয়ামী লীগ হিন্দুদের প্রতি এক ধরণের নির্ভরশীলতা খুঁজে পেয়েছে, আর বিএনপি মুসলমান ভোটের দিকে নজর দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে, একে অপরকে অপব্যবহার করা হয় এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভোট ব্যাংক ইস্যু নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার মধ্যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। এভাবে, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।

তবে, ইতিহাসের এই নৃশংসতা এবং বর্তমানের এই সংঘর্ষের মধ্যে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথাগুলি স্মরণীয় হয়ে থাকে, যেখানে তিনি লিখেছিলেন: “হিন্দু না ওরা মুসলিম?"—এটি প্রশ্ন করে যে, মানুষ আসলে জাতি-ধর্মের বাইরেও একই মানবিক মূল্য নিয়ে এখানে বসবাস করে।

তারিখ: ২৯.১১.২০২৪