চট্টগ্রামের হাজারী লেনে যা ঘটেছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ

চট্টগ্রামের হাজারী লেনে যা ঘটেছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ

চট্টগ্রামের হাজারী লেনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের অভিযানের সময় সিসি ক্যামেরা ধ্বংস, বাড়িঘরে তল্লাশি, এবং শতাধিক হিন্দুকে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযানের পেছনে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর উসকানি এবং স্থানীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই ঘটনার যথাযথ বিচার না হলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

চট্টগ্রাম, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪: চট্টগ্রামের হাজারী লেন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিচালিত এক অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪, রাতের অন্ধকারে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে এলাকাটি ঘিরে ফেলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অভিযান শুরুর আগে সিসি ক্যামেরা নিষ্ক্রিয় করে বাড়িঘরে ঢুকে তল্লাশি চালানো হয় এবং বহু হিন্দু পরিবার আতঙ্কের মধ্যে পড়ে।

অভিযানের অভিযোগ

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ৫৭ জন হিন্দু আহত হয়েছেন এবং প্রায় ২০০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আটককৃতদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে এবং আদালতে তাদের দাঁড়ানোর অবস্থাও ছিল না। পুলিশের দাবি, সেনাবাহিনীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যদিও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলেনি।

স্থানীয় উসকানি ও লুটপাট

জানা গেছে, অভিযানের আগে ওসমান মোল্লা নামে এক ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে হিন্দুদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য ছিল। স্থানীয় হিন্দু-মুসলিমরা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করলেও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তা মানতে নারাজ ছিল। ৫ নভেম্বর রাতে, ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো পুলিশের সহযোগিতায় ১৫-২০টি সোনার দোকান লুট করে।

সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভূমিকা

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অভিযানে দুটি দল সক্রিয় ছিল— একটি সম্পূর্ণ হিন্দু-বিরোধী এবং অন্যটি এ ধরনের কার্যক্রমের বিরোধী। অভিযোগ রয়েছে, মৌলবাদী ক্যাডাররা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মিলে লুটপাটে অংশ নেয়। নিরাপত্তা বাহিনী এখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

মানবাধিকার সংস্থার পদক্ষেপ

দ্য হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিজ (এইচআরসিবিএম)-এর একটি প্রতিনিধি দল স্থানীয় পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করলেও কোনো কার্যকর প্রতিক্রিয়া মেলেনি। এদিকে, গ্লোবাল বাংলাদেশি হিন্দু অ্যালায়েন্স এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ৮০ জনেরও বেশি হিন্দুকে মধ্যরাতে আটক করা হয়েছে এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।

হিন্দুদের অভিযোগ

একজন নারী আরাধ্যা সাহা অভিযোগ করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী ও মৌলবাদী ক্যাডাররা সমর্থকরা তার বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বাড়িতে প্রবেশ, মূল্যবান সামগ্রী লুট এবং আটকদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরএসএস-এর সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের বিষয়ে জানতে চেয়েছে এবং হিন্দু ধর্মীয় স্লোগানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই অভিযানকে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

এখন প্রশ্ন রয়ে গেছে, সংখ্যালঘু হিন্দুরা কি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সুরক্ষিত? বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এই প্রশ্ন থেকেই যাবে।

তারিখ: ১৭.১১.২০২৪