মাদারীপুরের কালকিনিতে ২৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ি মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দীপাবলি ও কালীপূজা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এ মেলাটি বন্ধে স্থানীয় ১২ জন ব্যক্তি অভিযোগ তুলে ধরেন, যা বিবেচনা করে উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভা মেলা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিযোগে মেলায় অপ্রীতিকর ঘটনাসহ নানা সমস্যা উত্থাপিত হয়েছে। তবে আয়োজক ও ব্যবসায়ীরা এ সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং মেলা স্থগিত হলে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
মাদারীপুর, ২৬ অক্টোবর: মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কুন্ডুবাড়ি মেলাটি দীপাবলি ও কালীপূজা উপলক্ষে প্রায় আড়াই’শ বছর ধরে হয়ে আসছে। প্রতি বছর হাজারো মানুষ এই ঐতিহ্যবাহী মেলাতে আসেন, যেখানে বিভিন্ন ধরনের দোকান বসে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য কেনা-বেচা হয়। কিন্তু এ বছর স্থানীয় ১২ জন ব্যক্তির আপত্তি ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেলাটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
মেলা আয়োজনের ইজারাদার আকবর হোসেন সরদার বলেন, “প্রতি বছর শান্তিপূর্ণভাবে মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এবার ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও স্থানীয় আলেম সমাজের প্রতিনিধিরা অভিযোগ তুলে ধরেছেন। তারা আমাকে বলেছেন, হিন্দুদের মেলায় মুসলমানদের যেতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এতে মুসলমানদের সঙ্গেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।” আকবর হোসেন আরও বলেন, “আমি পৌরসভা থেকে ইজারা নিয়ে অনেক দোকানিকে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছি। দোকানিরা ঋণ নিয়ে মালামাল প্রস্তুত করেছেন, কিন্তু মেলা বন্ধ হলে তাদের আর্থিক ক্ষতি হবে।”
আয়োজক ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কালকিনির ভূরঘাটা এলাকায় মেলাটি প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের অংশ। প্রতি বছর দীপাবলি ও কালীপূজাকে ঘিরে এই মেলায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। এবারে মেলার আয়োজন বন্ধ রাখতে স্থানীয় ১২ জন ব্যক্তি নয়টি কারণ উল্লেখ করে মেলাটি বন্ধের দাবি জানায়। অভিযোগকারীদের মধ্যে ভূরঘাটা বাজার মসজিদের ইমাম ওমর ফারুক বলেন, “আমরা মূলত ইসলামী আন্দোলনের কর্মী এবং স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে মেলা বন্ধের দাবি জানিয়েছি।” তবে তাদের দাবি ছিল, মেলার কারণে নানারকম অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে এবং সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
তবে মেলা আয়োজন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল কুন্ডু জানান, “কালীপূজাকে ঘিরেই এই মেলায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি হয়। কিন্তু রাতের আঁধারে কিছু মানুষ মেলা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে ব্যানার টাঙিয়েছে। কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন এবং মর্মাহত।”
পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে কালকিনি পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ বলেন, “স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি মেলার বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করে স্থায়ীভাবে বন্ধ রাখার জন্য লিখিত আবেদন করেছেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে এবার মেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।”
অভিযোগকারীদের উল্লেখিত নয়টি সমস্যার মধ্যে রয়েছে মেলায় মারামারি ও হত্যাকাণ্ড, জুয়া, মাদকসেবন, চাঁদাবাজি, সামাজিক অবক্ষয় এবং যানজট সৃষ্টি। কালকিনি কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও অভিযোগকারী গোলাম হোসেন বলেন, “আমরা স্থানীয়দের অভিযোগ তুলে ধরেছি, তবে কারও নাম উল্লেখ করিনি।”
মেলার ওপর স্থগিতাদেশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোছা. ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “মেলা আমাদের সংস্কৃতির অংশ এবং কুন্ডুবাড়ির মেলাটি একটি ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। মেলা বন্ধের বিষয়টি নিয়ে যারা অভিযোগ তুলেছেন, তাদের সাথে আলোচনায় বসে সমাধান খোঁজা হবে। তবে জেলা প্রশাসন মেলা বন্ধের পক্ষপাতী নয়।”
এমনকি মেলায় বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রের দোকান বসানো এবং প্রথাগতভাবে দীপাবলি ও কালীপূজার সময়কালে মেলা আয়োজন করে আসায় হাজারো দোকানি ও ব্যবসায়ী মেলাটিকে ঘিরে আর্থিকভাবে নির্ভরশীল। মেলা স্থগিত করা হলে দোকানিরা ঋণের বোঝা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলেও উল্লেখ করেন আয়োজকরা।
এই ঐতিহ্যবাহী মেলা বন্ধ রাখার বিষয়ে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ দেখা গেছে। যদিও স্থানীয় প্রশাসন সমস্যার সমাধানে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করার কথা জানিয়েছে, তবু এ সিদ্ধান্তে স্থানীয় সনাতন সম্প্রদায়ের মাঝে ক্ষোভ ও উদ্বেগ বিরাজ করছে।
তারিখ ২৬.১০.২০২৪