বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবী

বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবী

ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিয়ে একটি আলোচনাসভায় বক্তারা বাংলাদেশের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্ব সংকট সমাধানে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বক্তারা বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানকে বিভাজনমূলক আখ্যা দিয়ে বলেন, এতে বিভিন্ন জাতিসত্তা ও ধর্মের অধিকারকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সভায় মণবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়। আলোচকরা বলেন, সঠিক পরিকল্পনা ও রাজনীতির মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলের সংকট নিরসন করতে হবে এবং একটি বহুজাতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে।

ঢাকা, ৮ অক্টোবর: বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বক্তারা সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। তাদের মতে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায় এটি একটি জরুরি রাজনৈতিক সমাধান। বক্তারা বলেন, একটি প্রকৃত জাতীয় অগ্রগতির জন্য এবং বহুজাতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সংবিধানে এই সম্প্রদায়গুলোর স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি।

আলোচনা সভাটি “মণবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি: জুলাই মাসের গণজাগরণ, রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী অংশীদারিত্ব” শিরোনামে মাওরুম জার্নাল ও আইপিনিউজ বিডির যৌথ আয়োজনে মঙ্গলবার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আলোচকরা বর্তমান সংবিধানকে সংকীর্ণ ও বিভাজনমূলক বলে আখ্যা দেন এবং মণবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করেন। তারা উল্লেখ করেন যে, লারমা সব সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য একটি বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর পক্ষে ছিলেন, যা বর্তমান সংবিধানে অনুপস্থিত।

লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ আলোচনার সূচনা করেন এবং এতে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রবায়েত ফেরদৌস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন, লেখক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামন্তা শারমিন।

বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তির আহ্বান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রবায়েত ফেরদৌস বলেন, বর্তমান সংবিধান পুরুষতান্ত্রিক এবং বিভাজনমূলক। এটি বাঙালি ও মুসলিমদের অধিকারকে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু অন্যান্য জাতিসত্তা, ধর্ম ও ভাষার অধিকারের বিষয়ে চুপ থাকে। তিনি বলেন, “আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলি, কিন্তু আমাদের সংবিধান কেবল পুরুষদের জন্য, কেবল বাঙালিদের জন্য, কেবল মুসলিমদের জন্য এবং কেবল বাংলা ভাষার জন্য।”

ড. আমেনা মহসিন পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর জন্য প্রযোজ্য আইনগুলোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এবং চুক্তির অসংগতিগুলোকে তুলে ধরেন, যা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে। তিনি বলেন, “বাঙালি শ্রেষ্ঠত্বের দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সরলীকরণ ও হেয় করার প্রচেষ্টা চলছে।”

লারমার দৃষ্টিভঙ্গি
লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, লারমার দৃষ্টিভঙ্গি আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি একটি বহুজাতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন, যেখানে সমস্ত সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা পাবে এবং এককভাবে বাঙালি পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে না।

মাওরুম জার্নালের সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন ক্ষিসা বলেন, লারমা ১৯৭২ সালের গণপরিষদে বহুত্ববাদ ও আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এককভাবে লড়াই করেছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “রাষ্ট্র সংস্কারের যে কোনো প্রয়াসে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কণ্ঠস্বরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”

নতুন প্রজন্মের ভূমিকা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান এবং তাদেরকে এমন সংস্কার দাবি করতে বলেন, যা প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষিত করবে। তিনি বলেন, “পাহাড়ি জনগণের প্রতি আমাদের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে এবং তাদেরকে এই দেশের পূর্ণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।”

লেখক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ সংবিধান সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘুদের অনুপস্থিতির বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এবং বলেন, “সংখ্যালঘুদের মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই শুরু হয়েছিল যখন শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরকে বাঙালি হিসেবে আত্মীকরণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।”

কবি ও লেখক মিথুন রক্ষম উত্তরবঙ্গে সাম্প্রতিক বন্যার সময় সরকারের উদাসীনতার কথা উল্লেখ করেন এবং এর সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতি সরকারের প্রতিক্রিয়ার তুলনা করেন। তিনি বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক সাংবিধানিক স্বীকৃতির অভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো সবসময় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।”

সম্মুখপথ
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ও সাংবাদিক অনীক রায় বলেন, “পাহাড়ি সমস্যা একটি রাজনৈতিক সংকট, যা কেবল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের শোষণের মাধ্যমে কখনো সমাধান করা সম্ভব নয়। এটি একটি সমান অধিকার ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যেই নিহিত।”

আইনজীবী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য শায়ক চাকমা বলেন, “জুলাই মাসের গণজাগরণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অবদানকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না এবং তাদেরকে সমান অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে, যদি আমরা সত্যিই একটি ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই।”

আলোচনাটি পরিচালনা করেন আইপিনিউজের ডেপুটি এডিটর সতেজ চাকমা। এই আলোচনা সভার মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারকে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়।

তারিখ ১০.১০.২০২৪