বাংলাদেশে দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিমা নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন ঢাকার শাঁখারীবাজারের প্রতিমা শিল্পীরা। প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় তাদের কারখানাগুলোয় এক ধরনের সৃজনশীল ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়। এবার, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর সাম্প্রতিক আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে, পূজার প্রস্তুতি যেন আরও বেশি অর্থবহ হয়ে উঠেছে। বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই প্রতিমা তৈরির কাজ শুধু শিল্প নয়, বরং পূজা ও ভক্তির একটি অংশ। শাঁখারীবাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিমা শিল্পী বলাই পালের ওয়ার্কশপে ১৬ জন কারিগর এই কঠিন সময়েও অক্লান্ত পরিশ্রম করে দুর্গা প্রতিমা তৈরিতে নিয়োজিত আছেন।
ঢাকা, ৮ অক্টোবর: প্রতি বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রতিমা শিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করেন। ঢাকার পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক শাঁখারীবাজার এলাকাটি এই শিল্পীদের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এখানে প্রতিমা শিল্পীরা বছরের বিভিন্ন সময় দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরিতে নিয়োজিত থাকলেও, দুর্গাপূজা উপলক্ষে তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণ। দুর্গাপূজা, যা বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকও বটে।
শাঁখারীবাজারের ওয়ার্কশপগুলোতে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিমা তৈরির কাজ চলে। এরমধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল শ্রী শ্রী প্রণ বল্লভ জিউ মন্দিরের কারখানা, যেখানে প্রতিমা শিল্পী বলাই পালের নেতৃত্বে ১৬ জন কারিগর দিনরাত কাজ করে চলেছেন। তাদের কারখানার বয়স প্রায় ১৩০ বছর এবং এটি ঢাকার সবচেয়ে বড় প্রতিমা তৈরির ওয়ার্কশপ হিসেবে পরিচিত। এই ওয়ার্কশপে প্রতিমা তৈরির কাজটি শুধু একটি পেশা নয়, বরং এটি ভক্তির প্রতীক, যেখানে কারিগররা দেবী দুর্গার প্রতি তাদের নিবেদন প্রদর্শন করেন।
কারিগরদের কঠিন পরিশ্রম:
শাঁখারীবাজারের সরু গলির ভিতর দিয়ে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো কিছু স্থাপনার মধ্যে দিয়ে এই ওয়ার্কশপে পৌঁছানো সহজ নয়। সরু পথ, রিকশার হর্ন, আর পুরান ঢাকার সিগনেচার খাবারের গন্ধের মাঝে বলাই পালের কারখানা এক অনন্য স্থান, যেখানে প্রতিমা তৈরির এক গভীর ঐতিহ্য লালিত হয়ে আসছে। ওয়ার্কশপে প্রবেশ করতেই, বাহিরের সকল কোলাহল যেন মিলিয়ে যায়। ঘরে শুধু শোনা যায় তুলি ও মাটির ছোঁয়ার শব্দ, যা প্রতিমা তৈরির সৃজনশীলতা ও সাধনার পরিচয় দেয়।
প্রতিমা তৈরির কাজে কারিগররা সাধারণত দিনে আট থেকে নয় ঘণ্টা কাজ করেন। তবে দুর্গাপূজার সময় এই সময়সীমা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা। পূজার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই তারা ওয়ার্কশপেই খাওয়া-ঘুম করা শুরু করেন, যাতে সময়মতো প্রতিমা প্রস্তুত করতে পারেন। এই প্রচেষ্টার পেছনে আছে তাদের কঠোর পরিশ্রম ও দেবী দুর্গার প্রতি অগাধ ভক্তি।
ঐতিহ্যবাহী কৌশল ও আধুনিকতার মিশ্রণ:
প্রতিমা তৈরিতে শতাব্দী প্রাচীন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যেখানে বাঁশ, খড়, কাঠ এবং মাটি দিয়ে প্রতিমার অবয়ব তৈরি করা হয়। প্রতিটি প্রতিমা নির্মাণে প্রায় চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ সময় লাগে। প্রথমে বাঁশ ও কাঠের কাঠামো বানানো হয়, তারপরে তাতে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রতিমার গায়ে একাধিক মাটির স্তর দেওয়ার পর, তা শুকিয়ে সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। এরপর বলাই পাল নিজে চোখ ও মুখের সূক্ষ্ম অংশগুলো আঁকেন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করার জন্য নিখুঁত মনোযোগ ও সময়ের প্রয়োজন হয়।
আগের সময়ে দুর্গার প্রতিমাগুলোতে মাটির উপরে তুলনামূলকভাবে কম রঙের ব্যবহার করা হতো, এবং সাজসজ্জাও ছিল বেশ সরল। কিন্তু বর্তমানে, প্রতিমার পোশাক ও অলংকারের ক্ষেত্রে অনেক নতুনত্ব আনা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বলিউডের ট্রেন্ড অনুযায়ী প্রতিমার সাজসজ্জা এবং পোশাকেও এসেছে পরিবর্তন। আগে যেখানে মাটির রঙের সাথে মিশে থাকা তুলার শাড়ি ব্যবহার করা হতো, সেখানে এখন উজ্জ্বল রঙের সিনথেটিক কাপড়ের ব্যবহার বেশি দেখা যায়।
ভক্তির প্রতীক:
প্রতিমা তৈরির কাজটি শুধু একটি আর্ট নয়, বরং এটি এক ধরনের পূজা। এখানে কাজ করা প্রতিমা শিল্পীরা মনে করেন, তাদের কাজের মাধ্যমে তারা দেবী দুর্গাকে পূজা করছেন। তারা মাটির প্রতিমা তৈরি করার সময় কোনো ধরনের মাংস বা মদ্যপান থেকে বিরত থাকেন। কারিগর নীলান্দ্রি, যিনি এই ওয়ার্কশপে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন, বলেন, “দেবী দুর্গার শক্তি আমাদের এমন পরিশ্রম করতে সক্ষম করে। তিনি আমাদের হাতকে পরিচালনা করেন, যাতে আমরা তার অবয়বকে সঠিকভাবে তৈরি করতে পারি।”
উৎসবের শেষ পর্ব:
দুর্গাপূজার শেষ দিন বিজয়া দশমী, যা প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। ঢাকার শাঁখারীবাজারে প্রতিমা বিসর্জনের সময় হাজারো মানুষ একত্রিত হয়। তারা প্রতিমাগুলোকে বুড়িগঙ্গা নদীতে নিয়ে গিয়ে জলে বিসর্জন দেয়, যা দেবী দুর্গার তার স্বামী শিবের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এই সময়ে আনন্দের পাশাপাশি বিষাদও লক্ষ্য করা যায়, কারণ ভক্তরা দেবীকে বিদায় জানায়। বিসর্জনের পরে, প্রতিমা শিল্পীরা মনে করেন, তাদের এক বছরের সাধনা পূর্ণতা পেয়েছে এবং তারা পরের বছর আবারও এই পরিশ্রমের জন্য প্রস্তুত হন।
বলাই পালের মতো প্রতিমা শিল্পীরা শুধু শিল্পী নন, বরং তারা বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। তাদের কর্মশক্তি ও ভক্তি দুর্গাপূজাকে একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উপলক্ষ হিসেবে তুলে ধরে।
সূত্র: বিবিসি
তারিখ ১০.১০.২০২৪