বাংলাদেশের হিন্দুদের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি আসামের ধুবড়ি পূজামণ্ডপে

বাংলাদেশের হিন্দুদের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি আসামের ধুবড়ি পূজামণ্ডপে

আসামের ধুবড়ির ৩ নম্বর বালুরচর সার্বজনীন দুর্গাপূজা মণ্ডপ এবার হিন্দুদের ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মণ্ডপটি বিশেষভাবে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ঢাকেশ্বরী প্রতিমার কলকাতায় স্থানান্তরের ঘটনা তুলে ধরেছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথাও স্মরণ করিয়েছে। মণ্ডপটির নকশা ও শিল্পকর্ম দর্শকদের মধ্যে ইতিহাস, ধর্ম, এবং সামাজিক অন্যায়ের ওপর সচেতনতা সৃষ্টি করেছে।

ধুবড়ি, ১১ অক্টোবর: দুর্গাপূজার জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে ধুবড়ির ৩ নম্বর বালুরচর সার্বজনীন দুর্গাপূজা মণ্ডপ বিশেষ নজর কাড়ছে। এবারের মণ্ডপটি ইতিহাস ও সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে তুলে ধরেছে, যা দর্শনার্থীদের মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের বিষয়টি এতে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এই বছরের পূজামণ্ডপটি এক আবেগঘন এবং চিন্তাশীল উপস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চলমান নির্যাতন এবং ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে প্রতিফলিত করেছে। মণ্ডপের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হলো ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ঢাকেশ্বরী প্রতিমার ঢাকা থেকে কলকাতায় স্থানান্তরের ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দুদের যন্ত্রণার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা দাঙ্গা এবং সহিংসতার কারণে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।

৩ নম্বর বালুরচর সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সদস্য জনার্দন পাল এই প্রতিচ্ছবির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “৯০০ বছর পুরোনো ঢাকেশ্বরী প্রতিমাটি, যা দেবী দুর্গার একটি রূপ, দেশভাগের সময় ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে কলকাতার কুমারটুলিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এটি সেই সব বাঙালি হিন্দুদের প্রতিরোধ এবং বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠে, যারা পূর্ববঙ্গের সহিংসতার কারণে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।”

দেশভাগ, যা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, লক্ষ লক্ষ মানুষের যন্ত্রণাদায়ক স্থানান্তরের সাক্ষী ছিল। পূর্ববঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য ঢাকেশ্বরী মন্দির ছিল আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তবে, দেশভাগের সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মধ্যে অনেক হিন্দু পরিবারকে পালিয়ে যেতে হয়। প্রতিমার এই স্থানান্তর ছিল দেবী ও তাঁর ভক্তদের উত্তরাধিকারের সংরক্ষণ, যা তাদের বিশ্বাসকে সুরক্ষিত রাখতে এবং নতুন আশ্রয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল।

বালুরচর মণ্ডপে দর্শকদের একটি প্রতীকী যাত্রার মাধ্যমে ঢাকেশ্বরী প্রতিমার স্থানান্তরের ঘটনাটি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, কিভাবে শরণার্থী হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিমাটি ঢাকা থেকে কলকাতার দিকে পাড়ি জমায়। এ দৃশ্যগুলোতে ভয়ের অনুভূতি, হারানোর বেদনা এবং সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। দেবী দুর্গার প্রতিমার মতোই তাঁর ভক্তরাও নতুন আশ্রয়ে তাঁদের বিশ্বাস ধরে রেখেছেন।

মণ্ডপটি শুধু ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোতেই থেমে থাকেনি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন, বিশেষ করে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময়ের সহিংসতা, এটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বেড়েছে, এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার শিকার হয়ে সংখ্যালঘু হিন্দুরা চরম নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।

এই মণ্ডপের মাধ্যমে ৩ নম্বর বালুরচর সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটি এই সব নির্যাতিত হিন্দুদের পক্ষে একটি মর্মস্পর্শী বার্তা দিয়েছে। এর নান্দনিক শিল্পকর্ম ও স্থাপনাগুলো দর্শকদের জন্য কেবল একটি পূজা স্থল নয়, বরং একটি শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতাও প্রদান করেছে, যেখানে অতীত ও বর্তমানের নির্যাতনের কাহিনীকে সংযুক্ত করা হয়েছে।

একজন স্থানীয় দর্শনার্থী বলেন, “এ বছরের থিমটি আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা যখন আনন্দ-উৎসবের মধ্যে আছি, তখনও এমন সম্প্রদায় আছে, যারা দেবীর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কটি যন্ত্রণা এবং উদ্বাস্তু হওয়ার মধ্য দিয়ে পালন করেছে।”

বর্তমানে কলকাতার কুমারটুলিতে অবস্থানরত ঢাকেশ্বরী প্রতিমাটি এই সংযোগের প্রতীক হয়ে আছে। যদিও প্রতিমাটি আর ঢাকার মূল মন্দিরে নেই, তবুও এটি বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একতা এবং বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে।

এই অনন্য উদ্যোগটি শুধু পূজার আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেনি, বরং ইতিহাসের আঘাত এবং দক্ষিণ এশিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চলমান সংকট নিয়েও সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। শিল্প, ইতিহাস এবং ধর্মের মিশ্রণে বালুরচর মণ্ডপটি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অতীত ও বর্তমান সংগ্রামের একটি মর্মস্পর্শী প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ধুবড়ির এই মণ্ডপটি হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্ভীকতার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে নির্যাতন সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। হাজার হাজার দর্শনার্থী যখন বালুরচর দুর্গাপূজার সৌন্দর্য ও বার্তা দেখতে আসেন, তাঁরা তখন হিন্দুদের টিকে থাকার, স্থানান্তরের এবং ন্যায়বিচারের সংগ্রামের বৃহত্তর কাহিনীটিও স্মরণ করেন।

তারিখ ১২.১০.২০২৪