রাজশাহীর হিন্দুপল্লিতে হামলার পর চলছে রাত জেগে পাহারা, আতঙ্কে বাসিন্দারা

রাজশাহীর হিন্দুপল্লিতে হামলার পর চলছে রাত জেগে পাহারা, আতঙ্কে বাসিন্দারা

রাজশাহী, ৫ আগস্ট: রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বিদ্যাধরপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একদল লোক হামলা চালায়। মিছিল থেকে শুরু হওয়া এই হামলায় পাড়ার ২৫টি হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আতঙ্কে গ্রামের নারীরা পালিয়ে ফসলের মাঠে আশ্রয় নেন। হামলার পর থেকে স্থানীয় হিন্দুপাড়ার মানুষেরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। ১৪ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আশ্বাস দেন যে, আর কোনো হামলা হবে না।

রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বিদ্যাধরপুর গ্রামে ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মিছিল থেকে একদল লোক হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায়। ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে হঠাৎই বিদ্যুত্‍ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আর সেই সুযোগেই হামলাকারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। প্রায় ৩০-৪০ মিনিট ধরে চলা এই হামলায় অন্তত ২৫টি হিন্দু পরিবারের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আতঙ্কে গ্রামের নারীরা ফসলের মাঠে পালিয়ে যান, আর যারা পালাতে পারেননি, তারা বাইরের দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থাকেন।

হামলাকারীরা কোনো স্লোগান দেয়নি, হঠাৎ করেই একদিক থেকে হিন্দুপাড়ায় ঢুকে বাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর শুরু করে এবং অন্যদিক দিয়ে দ্রুত চলে যায়। এ সময় হামলা প্রতিহত করতে গেলে আমরাইল উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক সুকুমার প্রামাণিক (৪৫) গুরুতর আহত হন। তিনি হামলাকারীদের সামনে গিয়ে তাদের প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা এসব করছ কেন?’ কিন্তু তার প্রতিবাদের পরেই তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়, যার ফলে তার বাঁ হাত ভেঙে যায়। পরবর্তীতে হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার হাতের চিকিৎসা করা হয়। সুকুমার প্রামাণিকের কথায়, গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে সম্মান করত। তার বিশ্বাস ছিল না যে গ্রামের ছেলেরা তার ওপর হামলা চালাতে পারে।

পাড়ার অন্য বাসিন্দা, ভীমনগর হাইস্কুলের শিক্ষক শ্যামল কুমারের বাড়িতেও সেদিন হামলা হয়। হামলাকারীরা তার ঘরের টিনের চালা ভেঙে ফেলে। তার স্ত্রী সুচিত্রা রানী বলেন, ‘ওরা যখন বাড়ির গেট ভাঙার চেষ্টা করে, তখন ভেতরে আমরা ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।’

মোহনপুর কলেজের শিক্ষক ববিন কুমার সরকার এবং তার ভাই বিপুল কুমার সরকারের বাড়ির টিনের চালা, জানালা এবং শৌচাগারের পাইপ ভেঙে দেওয়া হয়। বিপুল কুমারের স্ত্রী পপি রানী সরকার বলেন, ‘আমরা বাইরের গেট বন্ধ করে ভেতরে লুকিয়ে ছিলাম। ওরা চেষ্টা করেও গেট ভাঙতে পারেনি।’

গ্রামের আরও কয়েকটি পরিবারের বাড়িতে হামলা হয়েছে। বিশ্বজিৎ প্রামাণিকের বাড়ির জানালার থাই গ্লাস এবং পানির ট্যাংক ভেঙে ফেলা হয়েছে। আশুতোষ প্রামাণিকের বাড়ির জানালার দুটি গ্লাস ভাঙচুর করা হয়, যার মধ্যে একটি মেরামত করতে ৩,৩০০ টাকা খরচ হয়েছে। উপেন প্রামাণিকের গরুর ঘরের চালা এবং তার দোকানও ভাঙচুর করা হয়। তার স্ত্রী আরতি প্রামাণিক বলেন, ‘দোকানে তখনো মালামাল তোলা হয়নি। এই অবস্থায় দোকানটি ভেঙে ফেলা হয়, এখন দোকান চালু করার সাহস পাচ্ছি না।’

সুদর্শন চন্দ্র সরকারের বাড়ির জানালার গ্লাস ভেঙে দেওয়া হয়, আর বিদ্যুতের মিটারও ভাঙচুর করা হয়। হামলার সময় তার বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য ছিলেন না, মেয়েরা ভয়ে দরজা বন্ধ করে ভেতরে ছিলেন। দীপক সরকারের বাড়ির তিনটি জানালার গ্লাস ভাঙচুর করা হয়েছে, যা এখনো মেরামত করা হয়নি। নারায়ণ সরকারের বাড়ির বারান্দার চালা, অজিত সরকারের দোকান, পরশুরাম প্রামাণিকের বাড়ির দুটি বারান্দার চালা এবং সুষেন প্রামাণিকের শৌচাগারের পাইপও ভাঙচুর করা হয়। অবিনাশ সাহার বাড়ির জানালার কাচ, রান্নাঘরের চালা এবং ঘরের ভেন্টিলেটর ভাঙা হয়। তার স্ত্রী মলিনা সাহা বলেন, ‘হামলার সময় আমরা ভেতরে দরজা বন্ধ করে ছিলাম। ওরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি।’

অজিত সরকারের চায়ের দোকানও ভাঙচুর করা হয়। হামলার পর থেকে বিদ্যাধরপুর হিন্দুপাড়ার মানুষজন আতঙ্কে আছেন, তারা রাত জেগে মন্দির ও বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছেন।

মোহনপুর থানায় গিয়ে জানা যায়, বিদ্যাধরপুরের কেউই এ ঘটনায় কোনো মামলা করেননি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হরিদাস মণ্ডল গ্রাম পরিদর্শন করেছেন এবং বলেন, স্থানীয়ভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। মৌগাছি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউনুস আলী বলেন, এটা মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

১৪ আগস্ট রাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়শা সিদ্দিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে বিদ্যাধরপুর মন্দির পরিদর্শনে আসেন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে আশ্বাস দেন যে, ভবিষ্যতে এমন কোনো হামলার ঘটনা আর ঘটবে না। এরপর ১৬ আগস্ট স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে স্থানীয় নেতারা প্রতিশ্রুতি দেন যে, এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। তার পর থেকে আর কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।

সূত্র: প্রথম আলো

তারিখ ২৩.০৮.২০২৪