বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম মতাদর্শিকভাবে সাম্প্রদায়িক?

বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম মতাদর্শিকভাবে সাম্প্রদায়িক?

১৩ অক্টোবর থেকে পরবর্তী ৬দিনে মন্দির ও পূজামণ্ডপসহ ১০১টি ধর্মীয় স্থাপনা, এবং ১৮১টি বাড়ি ও দোকানপাটে হামলা হয়েছে৷ কিন্তু এবারই প্রথম একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, সেটি হলো- কুমিল্লার ঘটনার পর আমাদের টিভি চ্যানেলসহ বেশিরভাগ গণমাধ্যম পুরোপুরি নিশ্চুপ ছিল৷ যেখানে তেলাপিয়া মাছের প্রজনন ক্ষমতার গতিতে বৃদ্ধি পাওয়া আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো একটি ফিতা কাটার খবর সরাসরি সম্প্রচার করতে পিছপা হয় না সেখানে তারা এত বড় একটি ঘটনাকে ব্ল্যাক আউট করেছিল৷ এ নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যেও প্রশ্ন দেখা দেয়৷

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়৷ ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে, ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়ায়, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০১৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে, ২০১৯ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিনে, চলতি বছর সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুপল্লিতে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে৷ বাংলাদেশে গত দুই দশকে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে যে দলই জিতুক না কেন প্রতিটি নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুরা ব্যাপক হামলার শিকার হয়েছে৷

গণমাধ্যমগুলোতে উপস্থাপনা

প্রতিবারই আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে দু ধরনের উপস্থাপনা দেখা গেছে, এক. লিবারেল মতাদর্শে বিশ্বাসী গণমাধ্যমগুলোতে ঘটনার সাদামাটা প্রকাশ; দুই. ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাসী গণমাধ্যমগুলোতে ঘটনাগুলোর একপেশে ও খণ্ডিত উপস্থাপনা ছিল৷ এবারই প্রথম দেখা গেলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় নীরব থাকার উদাহরণ৷

২০০২ সালে গুজরাট (গোধরা) দাঙ্গার পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা দাঙ্গার ঘটনা অনেকদিন ধরেই গণমাধ্যমে খবর হতো না৷ ব্যাপক সমালোচনার পর ২০১৭ সাল থেকে আবার তারা দাঙ্গার খবর পুরোদস্তুর প্রচার করতে শুরু করে৷ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সহিংসতার খবর প্রচার না করার পেছনে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকদের যুক্তিটি ছিল, এ ধরনের খবর প্রকাশ হলে সেগুলো অন্যান্য জায়গায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াতে উস্কানি দেবে৷

বাংলাদেশেও কুমিল্লার পূজামণ্ডপে হামলার খবর ব্ল্যাকআউট করার পেছনে টকশোতে একটি টিভির কর্তাব্যক্তিকে একই যুক্তি দিতে শুনেছি৷ পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতবর্ষের সাংবাদিকরা তাদের আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন দুটি কারণে৷ প্রথমত: গণমাধ্যমের চিরায়ত যে দায়িত্ব সঠিক ও নির্ভুল তথ্য তুলে না ধরলে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়৷ নির্যাতিতরা এমনিতেই প্রান্তিক অবস্থানে থাকেন৷ ফলে গণমাধ্যম যদি তার প্রহরীর ভূমিকা থেকে সরে যায় তাহলে তারা আরও প্রান্তিক অবস্থানে চলে যান৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্যেকটি দেশে চিরায়তরূপে সাম্প্রদায়িকতা জনজীবনের একটি নিয়মিত অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত হলো এর কুৎসিত অভিব্যক্তি৷ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা হামলায় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কোন গবেষণা না হলেও ভারতে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে৷

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর ব্ল্যাক আউট

২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দাঙ্গায় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয় টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলো যখন সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক খবর এবং মতামত প্রকাশ করেছিল তখন জাতীয় ইংরেজি দৈনিকগুলো প্রকৃত খবর প্রকাশ করেছিল, যার কারণে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতন বন্ধে তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়া হয়৷

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর ব্ল্যাক আউটের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দ্বিতীয় কারণটি হলো সামাজিক গণমাধ্যমের প্রভাব ও ভুয়া খবরের আধিক্য৷ এখন সামাজিক মাধ্যম এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, অনেক সময়ে বিকৃত করে এমন কিছু তথ্য ছড়ানো হয় যাতে দাঙ্গা, সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে৷ সামাজিক মাধ্যমের এই চাপ আটকাতে গেলে সত্যিটা জানাতে হবে, বাস্তবে কী হচ্ছে, সেটা দেখাতে হবে৷

সামাজিক মাধ্যমের গুজবের সমান্তরালে বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যমগুলোর দায়িত্বশীলভাবে সংবাদ পরিবেশন এখন সময়ের দাবি৷ ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গায় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে লজ্জাজনক৷ সরকারি চাপে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো প্রথমে কিছুই ঘটেনি এমন ভাব নিয়েছিল৷ পরে নির্যাতিত শিখদের বিরুদ্ধে একপেশে সংবাদ পরিবেশন করেছিল৷ ফলশ্রুতিতে শিখরা একেধারে স্থানীয় ও জাতীয় উভয় পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল৷ ভারতীয় গণমাধ্যম গবেষকরা মনে করেন, ১৯৮৪ ও ২০০২ সালের দুটো ঘটনায় গণমাধ্যম তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারলে অর্থাৎ যা ঘটেছে তা ঠিক এবং যথাযথভাবে তুলে ধরলে হতাহতের ঘটনা অনেক কম হত৷

গণমাধ্যমের দায়িত্ব

প্রতিবারই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনার পর এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা গণমাধ্যমে দেখি৷ দেখি কিছু সাদামাটা রিপোর্ট৷ কিন্তু সব সরকারের আমলেই সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাদের সম্পত্তি দখলের পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর যে প্রভাব তা নিয়ে গণমাধ্যমে কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখা যায় না৷ প্রতিবার নির্বাচনের পর ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাগুলো নিয়ে কি আমাদের কোন গণমাধ্যম আজ পর্যন্ত কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে? ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশব্যাপী হামলার পর তদন্ত কমিটির যে সুপারিশ করেছিল সেগুলো কেন বাস্তবায়িত হয়নি সে প্রশ্ন কি কখনও বাংলাদেশের গণমাধ্যম করেছে? কেন একটি হামলার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার আজও হয়নি সে কারণ অনুসন্ধান করেছে? সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করা, অপরাধীদের শাস্তির বিধান করা, নির্যাতনের কারণগুলো চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকারের ব্যবস্থা করা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এসব কিছুই বাংলাদেশে হয়নি৷ এতগুলো অনিবার্য প্রয়োজন কেন সম্পাদন হলো না সে প্রশ্ন রাখার কথা ছিল বাংলাদেশের মূলধারা গণমাধ্যমগুলোর, কিন্তু তারা রাষ্ট্রের মতই তারা জনগণের একটি অংশকে কার্যত অবহেলা করে গেছে৷ বাংলাদেশে যে ধরনের হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থা (গণতন্ত্রও নয়, একনায়কতন্ত্র নয়) তাতে গণমাধ্যমের এ দায়িত্ব পালন করা সবচেয়ে জরুরি।

রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের প্রভাব বলয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া

বসুন্ধরা গ্রুপ

বসুন্ধরার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের তিনটি সংবাদপত্র কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং ডেইলি সান৷ আছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম এবং টিভি চ্যানেল নিউজ ২৪৷ এছাড়া এফএম রেডিও স্টেশন রেডিও ক্যাপিটালও তাদের৷ এই মিডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর৷

বেক্সিমকো গ্রুপ

এই গ্রুপের টেলিভিশন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি৷ মালিক বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান৷

স্কয়ার গ্রুপ

এই গ্রুপের টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টেলিভিশন৷ এর কর্ণধার স্কয়ার গ্রুপের অধীনে থাকা স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী৷

ইমপ্রেস গ্রুপ

টেলিভিশন চ্যানেল, চ্যানেল-আই এর মালিকানা ইমপ্রেস গ্রুপের৷ এর কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর৷

মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশান কোম্পানি

টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলা এবং এটিএন নিউজ এই কোম্পানির৷ এর কর্ণধার মাহফুজুর রহমান৷

ইত্তেফাক গ্রুপ অফ পাবলিকেশনস লিমিটেড

সুপরিচিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক এই কোম্পানির৷ এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী৷ বর্তমানে ইত্তেফাকের সম্পাদক জাতীয় পার্টি নেতা, সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী তাসমিমা হোসেন এবং প্রকাশক মঞ্জু-তাসমিমা দম্পতির কন্যা তারিন হোসেন৷

এইচআরসি গ্রুপ

বাংলা পত্রিকা যায় যায় দিন এবং ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউএজ এই গ্রুপের৷ এর মালিক আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর ভাই সাঈদ হোসেন চৌধুরী৷ সাবের হোসেন চৌধুরী কর্ণফুলি গ্রুপের মালিক৷ সেই সুবাদে দেশ টিভির কর্ণধার তিনি৷

সিটি পাবলিশিং হাউজ লিমিটেড

এই কোম্পানির পত্রিকা দৈনিক দিনকাল৷ এর মালিক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷

হামিম গ্রুপ

চ্যানেল-২৪ টেলিভিশন এবং সমকাল পত্রিকার মালিক৷ এর কর্ণধার আওয়ামী লীগ নেতা একে আজাদ৷

ট্রান্সকম গ্রুপ

বাংলাদেশের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের মালিক এই গ্রুপ৷ প্রয়াত শিল্পপতি লতিফুর রহমান এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা৷ প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণও রয়েছে৷

বেঙ্গল গ্রুপ

টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির মালিক বেঙ্গল গ্রুপ৷ এর কর্ণধার মোর্শেদ আলম এমপি৷

এনটিভি

বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালু এর মালিক৷ তিনি একজন ব্যবসায়ী৷

গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার

জনকণ্ঠ পত্রিকার মালিক এই শিল্প পরিবার৷

রূপায়ন গ্রুপ

দৈনিক পত্রিকা দেশ রূপান্তর এই গ্রুপের৷ রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল৷

সিটি গ্রুপ

সময় টেলিভিশনের মালিক এই গ্রুপ৷ সবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভাই এর কর্ণধার৷

মেঘনা গ্রুপ

একাত্তর টেলিভিশন এই গ্রুপের৷ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান মোস্তাফা কামাল এই গ্রুপের কর্ণধার৷ তবে সাংবাদিক মোজাম্মেল হক বাবু’র শেয়ার রয়েছে এতে৷

শ্যামল বাংলা মিডিয়া

টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশন এই মিডিয়া কোম্পানির৷ এর কর্ণধার আবদুল হক৷ তবে নেপথ্যে মালিকানায় বিএনপির প্রয়াত সাংসদ সাদেক হোসেন খোকার নাম শোনা গেলেও নথিপত্রে তার নাম নেই বলে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে৷

যমুনা গ্রুপ

দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা এবং যমুনা টেলিভিশন এই গ্রুপের৷ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যুর পর থেকে তার স্ত্রী সালমা ইসলাম এই গ্রুপের চেয়ারম্যান৷ সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য তিনি৷

(‘হু ওনস দ্য মিডিয়া ইন বাংলাদেশ’ গবেষণা প্রতিবেদনটির লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ এবং গবেষক মো. সাজ্জাদুর রহমান৷ প্রকাশক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ,ঢাকা)

সংবাদ সূত্র: ডয়চে ভেলে

তারিখ ২২.১০.২০২১