বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৮ - বিশ্বের প্রতিবাদ, ভারতের হস্তক্ষেপ
Categories:
by Massimo Introvigne
পর্ব ৮/ ৮

আমার প্রজন্মের কাছে “বাংলা দেশ” প্রথমে ছিল জর্জ হ্যারিসনের (১৯৪৩–২০০১) একটি গান। পরে ১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে তাঁর ও রবি শঙ্কর (১৯২০–২০১২)-এর আয়োজিত কনসার্ট। যেখানে বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, ও এরিক ক্ল্যাপটনের মতো তারকারা অংশ নিয়েছিলেন। হ্যারিসন ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে বিশ্বকে সচেতন করার দুই প্রধান মানুষের একজন। অন্যজন ছিলেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮–১৯৮৬)। হ্যারিসনকে সবাই মনে রেখেছে, মাসকারেনহাসকে অনেকেই ভুলে গেছেন। অথচ মাসকারেনহাস না থাকলে হ্যারিসনের কনসার্টও হয়তো হতো না।
মাসকারেনহাস গোয়ান ক্যাথলিক। ছোটবেলায় পরিবার নিয়ে করাচিতে যান। তিনি সাংবাদিক হন এবং মর্নিং নিউজ-এর সহকারী সম্পাদক। তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল “শান্তি অভিযান” কভার করতে। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি দুটি সত্য বুঝে যান। এক—পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালাচ্ছে। দুই—এ কথা লিখলে পাকিস্তানের কোনো সংবাদপত্র তা ছাপবে না।
তিনি করাচিতে থাকা স্ত্রীকে বলেন—শিশুদের নিয়ে দ্রুত লন্ডনে চলে যেতে। তারপর তিনি লন্ডনের Sunday Times-এ যোগাযোগ করেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয় ১৩ জুন ১৯৭১-এ। শিরোনাম ছিল সরল—“Genocide।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭–১৯৮৪) পরে জানান—মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনই তাঁকে সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় যে ভারতকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এরপর তিনি ইউরোপ, রাশিয়া ও মস্কোয় কূটনৈতিক প্রচারণা চালান ভারতের সামরিক পদক্ষেপের পথ তৈরি করতে। মাসকারেনহাস তখন নিরাপদে লন্ডনে। সেখানে তিনি দীর্ঘ ও সম্মানজনক সাংবাদিকতা জীবনে প্রবেশ করেন।
ইন্দিরা ইউরোপ ও রাশিয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নয়। এই দুই দেশ পাকিস্তানকে আঞ্চলিক মিত্র মনে করত, এবং সোভিয়েত-ঘনিষ্ঠ ভারতের বিরুদ্ধে ভারসাম্য বলে দেখত। মার্কিন কূটনীতিকরা গণহত্যার খবর জানালেও প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন (১৯১৩–১৯৯৪) ও হেনরি কিসিঞ্জার ভারতের পক্ষে কোনো ইঙ্গিত দিতে রাজি ছিলেন না। বরং পাকিস্তানকে সহায়তার হুমকি দিয়েছিলেন।
নিক্সন ও কিসিঞ্জার ভেবেছিলেন—আমেরিকান জনগণ পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে খুব একটা ভাবছে না। কিন্তু মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর রবি শঙ্কর জর্জ হ্যারিসনকে তা দেখান। কনসার্ট শরণার্থী ও মানবিক সংকটে মনোযোগ দিয়েছিল, কিন্তু হত্যাকারীরা কারা—তা অস্বীকারযোগ্য ছিল না।
১ আগস্ট কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। এটি রক ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়। ১৭ আগস্ট সিনেটর টেড কেনেডি (১৯৩২–২০০৯), যাঁর নির্বাচকক্ষের অনেক হিন্দু নাগরিক ক্ষুব্ধ ছিলেন, মার্কিন প্রশাসনের “গণহত্যা সমর্থনের” বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালান। এটি আমেরিকার প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়।
কনসার্ট একাই সব বদলে দেয়নি। কিন্তু জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রভাব কম নয়। অনুষ্ঠানটি দেখার পর বহু মাধ্যম বাধ্য হয় জানাতে—“বাংলাদেশ সংকট” আসলে কী। তারা গণহত্যার কঠোর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চাইলেও, শরৎ নাগাদ স্পষ্ট হয়—ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ আমেরিকান ভোটারদের কাছে অত্যন্ত অজনপ্রিয় হবে।
ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে—ভারত কি আরও আগে হস্তক্ষেপ করতে পারত? কারণ ভারত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেও গণহত্যা চলছিল। কিছু ডায়েরি অনুযায়ী—ইন্দিরা গান্ধী এপ্রিলেই যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেলরা জানান—বর্ষাকালে আক্রমণ ঠিক হবে না, প্রস্তুতির সময় লাগবে। ওই সময় ভারত মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেয়।
নভেম্বরে ভারতের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে এখনও সন্দেহ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে লোকজন ভারতবিরোধী জিহাদের দাবি তুলছিল—যেন কাশ্মীর সমস্যাও একসাথে মিটে যায়।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান একটি গুরুতর ভুল করে—যেমন ১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হারবারে করেছিল। বিকাল ৫:৪০-এ পাকিস্তানি বিমান বাহিনী “অপারেশন চেঙ্গিজ খান” শুরু করে—উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ধ্বংস করা। তারা একসঙ্গে ১১টি ভারতীয় ঘাঁটিতে আক্রমণ করে এবং কাশ্মীরে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। পাকিস্তান দাবি করেছিল—তারা ইসরায়েলের “অপারেশন ফোকাস” থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু পাকিস্তানের বিমান শক্তি ছিল দুর্বল। অনেক বোমাই বিস্ফোরিত হয়নি। অল্প কিছু ভারতীয় বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবুও এটি ছিল সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। ইন্দিরা গান্ধীর জন্য বিশ্বকে বলা সহজ হয়ে উঠল—ভারত আক্রান্ত হয়েছে, তাই পাল্টা জবাব দিচ্ছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাঁটিতে হামলা চালায়। ভারতীয় সেনা, যারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছিল, দ্রুত অগ্রসর হয়ে দুই সপ্তাহের কম সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে। ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথ অবরোধ করে। ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা পতন হয়। ১৬ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল এ এ কে নিয়াজি (১৯১৫–২০০৪) লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার (১৯১৬–২০০৫) কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন।
ভারতে তখন দাবি উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু ১১ ডিসেম্বর মার্কিন পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর জবাবে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ ও সাবমেরিন পাঠায়। চীনও সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে, কিন্তু সীমান্ত পেরোয়নি। ভারতও সেখানে আটটি ডিভিশন প্রস্তুত রেখেছিল। কেউই বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ চাইছিল না। ইন্দিরাও যুদ্ধ বাড়াতে চাননি। ২ জুলাই ১৯৭২ শিমলায় চুক্তি হয়—পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
যুদ্ধ ও গণহত্যা শেষ হয়। কিন্তু পরিণতি ছিল কঠিন। বিহারিদের মতো গোষ্ঠী—যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল—বাংলাদেশে নিপীড়িত হয়, বহু মানুষ নিহত হয়। সহযোগী কয়েকজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারীরা কখনও বিচার পায়নি।
ঘৃণা রয়ে যায়। বাংলাদেশে এখনো মৌলবাদীরা হিন্দু সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে সহিংসতা চালায়। ১৯৭১-এর ইতিহাস বোঝা এবং জানানো—এই ধারাবাহিক লেখার উদ্দেশ্য ছিল সেটাই।