বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৭ - হিন্দুধর্ম নিশ্চিহ্নের চেষ্টা
Categories:
by Massimo Introvigne
পর্ব ৭/ ৮

বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, এবং পরে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার আন্দোলন—এসবই মূলত বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের নেতৃত্বে হয়েছিল। তবুও ১৯৭১-এর গণহত্যায় সবচেয়ে নিষ্ঠুর আঘাত আসে হিন্দুদের ওপর। পশ্চিম পাকিস্তানিরা হিন্দু হত্যায় থামেনি, এমনকি তাদের জেনারেলরা সতর্ক করেছিলেন—এতে ভারতীয় সেনা হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
এটি কোনো ভুল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের মতবাদে পূর্ব পাকিস্তানিরা “অশুদ্ধ” বা “খারাপ” মুসলমান—এর মূল ছিল তাদের ওপর “গোপন হিন্দু প্রভাব” থাকার অভিযোগ। বলা হত—হিন্দু সংস্কৃতির কারণে তাদের ইসলাম দুর্বল হয়েছে।
যুক্তি ছিল—পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা “অনেকটাই ধর্মীয়ভাবে উদাসীন,” এবং হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে থাকার প্রবল মনোভাব ছিল না। তাই “শুদ্ধ” মুসলমান বানাতে হলে—হিন্দুদের সরিয়ে দেওয়া দরকার।
পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলরাও জানতেন—পূর্ব পাকিস্তানের নয় মিলিয়নের বেশি হিন্দুকে সবাইকে হত্যা করা অসম্ভব। তবে তারা বিশ্বাস করত—একটা বড় অংশ হত্যা করলে বাকিরা ভারত পালাবে।
তা ঠিকই হয়েছিল। আট মিলিয়নের যে শরণার্থী ভারতে যায়—তার দুই-তৃতীয়াংশই ছিল হিন্দু। পশ্চিম পাকিস্তান বুঝতে পারেনি—এত বিশাল শরণার্থী প্রবাহের চাপ ভারতকেও যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।
১৯৭১-এ অস্বাভাবিক সংখ্যক হিন্দু নিহত হয়। তখন হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ২০%। কিন্তু অনুমান করা হয়—মোট নিহতের ৫০% পর্যন্ত হিন্দু হতে পারে। গণহত্যা বিশেষজ্ঞ আমেরিকান গবেষক রুডলফ জোসেফ রামেল লিখেছেন—পশ্চিম পাকিস্তানিরা ও তাদের মৌলবাদী সহযোগীদের চোখে “বাঙালি হিন্দুরা ছিল নাৎসিদের চোখে ইহুদিদের মতো—নিশ্চিহ্ন করার মতো বিষাক্ত প্রাণী।”
এই তুলনা আরও স্পষ্ট হয় কারণ পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিন্দুদের ঘরে হলুদ “H” চিহ্ন আঁকতে বাধ্য করত—যাতে সহজেই টার্গেট চিহ্নিত করা যায়।
তারা দাবি করত—হিন্দু নারীকে হত্যা করা হয় না, শুধু পুরুষদের। কিন্তু ভারতে যাত্রাপথের শরণার্থী দলগুলিতে হামলা হলে নারী-শিশুরাও মারা যেত। চুকনগরের ১০,০০০ নিহতের মতোই—২৩ এপ্রিল ১৯৭১-এ জাঠিভাঙায় প্রায় ৩,০০০ হিন্দু শরণার্থীকে হত্যা করা হয়।
গণহত্যার প্রথম দিকেই পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায়—শাঁখারি হিন্দুরা শাঁখা তৈরি করতেন। সেখানে ২০০-র বেশি পুরুষ–নারী–শিশুকে হত্যা করা হয়। অধিকাংশ হিন্দু নারীকে হত্যা না করে বরং ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করা হয়, পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া হয়, বা জোরপূর্বক বিয়ে করা হয়—যেমনটি মুসলিম বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রেও হয়েছিল।
কত হিন্দু নিহত হয়েছিল বা কত হিন্দু নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন—এটি সামগ্রিক গণহত্যা পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে। অনুমান—১ লক্ষ হিন্দু নারী ধর্ষিত এবং ৭ লক্ষ হিন্দু পুরুষ নিহত। তবে সঠিক সংখ্যা হয়তো আর জানা যাবে না।
হিন্দু মন্দির ও গ্রন্থাগারও আক্রমণ ও লুট করা হয়। এতে বহু অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ হারিয়ে যায়। ভয়ংকর উদাহরণ—ঢাকার রমনা কালী মন্দির ধ্বংস, যা মোগল আমল থেকে ছিল। মন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থিত আনন্দময়ী মা-র আশ্রমও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই হামলায় ৮৫ হিন্দু নিহত হন।
যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা ঘোষণার পর অধিকাংশ শরণার্থী বাংলাদেশে ফিরে আসে। তখন ঘোষণা করা হয়েছিল—ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগী মৌলবাদী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হবে।
তাদের আশা বেশিদিন টেকেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান “ধর্মনিরপেক্ষ ইসলাম”–এ বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫-এ তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে মৌলবাদী শক্তি আবার সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কন্যা হলেও, তাঁকেও নানা শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এর প্রমাণ—গণহত্যার ছায়া এখনো সমাজে রয়ে গেছে।