বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৬ - নির্মম হত্যাযজ্ঞ
Categories:
by Massimo Introvigne
পর্ব ৬/ ৮

পূর্বের লেখাগুলোতে দেখেছি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে বাধা দিতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মার্চ ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। এরপর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে—বাংলাদেশ নামে।
প্রতিরোধ শক্তিশালী হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান আরও সৈন্য পাঠায় এবং স্থানীয় সহযোগী মিলিশিয়া গঠন করে। ঘটনার পঞ্চাশ বছর পর পাওয়া দলিলগুলো দেখায়—এপ্রিলের পর পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঠিক করেছিল, পূর্ব পাকিস্তানের সমাজের কিছু অংশকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে হবে। লক্ষ্য ছিল—পূর্ব বাংলা থেকে আসা সেনা ও পুলিশ যারা সহযোগিতা করেনি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী, এবং হিন্দু পুরুষরা। হিন্দু নারীরা ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তির জোর, বা জোরপূর্বক বিয়ের শিকার হন।
হিন্দুদের প্রসঙ্গে পরের লেখায় ফিরব। খ্রিস্টানদেরও আক্রমণ করা হয়েছিল। যেমন, রাঙামাটিয়া গ্রামে—যেখানে বেশিরভাগই ক্যাথলিক—৯০% ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ১৪ জন নিহত হন। চার্চ লুট করা হয়; পূর্ব পাকিস্তানের আরও ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
অন্য সমস্ত শ্রেণীই ছিলেন মুসলিম। অর্থাৎ, ১৯৭১-এর হত্যাযজ্ঞ ছিল—মুসলমানের হাতে মুসলমান নিধন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকে পূর্ব বাংলার ইসলামকে কুসংস্কার ও লোকাচারের দ্বারা “দূষিত” মনে করত। গণমাধ্যম দাবি করে—শুধু “বিদ্রোহী” বা “বিচ্ছিন্নতাবাদীদের” টার্গেট করা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ যত এগোয়, সব সক্ষমদেহী বাঙালি পুরুষকেই সম্ভাব্য বিদ্রোহী হিসেবে ধরা হয়।
ভারতে পালাতে চাওয়া লোকজনকেও বিদ্রোহী ভাবা হত, যদিও অনেকেই শুধু যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে পালাচ্ছিলেন। সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হয় চুকনগরে—মে ১৯৭১-এ প্রায় ১০,০০০ শরণার্থী ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১০ মে—পুরো জনসমাবেশকে হত্যা করা হয়, নারী-শিশুসহ।
পশ্চিম পাকিস্তান মনে রেখেছিল—বাঙালি ভাষা ও পরিচয়কে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নেন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা। তাই তাঁদের পরিকল্পিতভাবে খুঁজে হত্যা করা হয়। উপন্যাসিক, নাট্যকার, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পীদের দলবদ্ধভাবে হত্যা করা হয়। বিজ্ঞান, আইন, অর্থনীতি ও চিকিৎসা-বিজ্ঞানের শিক্ষকরাও রেহাই পাননি। যুদ্ধ প্রায় হেরে যাওয়ার পরও সৈন্যরা ও সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা চালিয়ে যায়—ভাবতে যে এতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নেতৃত্বহীন হবে। কলেজ ছাত্ররাও একইভাবে লক্ষ্যবস্তু ছিলেন।
অধিকাংশ নিহত ছিলেন পুরুষ। অনেক ইতিহাসবিদ একে “জেন্ডারসাইড”—অর্থাৎ পুরুষনিধন—বলেন। তবে নারীরাও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। ২ থেকে ৪ লক্ষ বাঙালি নারী ধর্ষিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানের উগ্র ধর্মীয় নেতারা ঘোষণা দেন—“বিদ্রোহী” নারীরা সৈন্যদের জন্য “যুদ্ধলব্ধ সম্পদ”।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা যুদ্ধের শেষদিকে দেখেন—হাজার হাজার নারীকে “মিলিটারি ব্রোথেল”-এ আটকে রাখা হয়েছে। অনেককে জোরপূর্বক বিয়ে করা হয়েছে। যুদ্ধশেষে অসংখ্য নারী গর্ভবতী ছিলেন। ওই ধর্মীয় নেতারা বলেছিলেন—“ভাল মুসলিমের বীজে” তারা “ভাল প্রজন্ম” জন্ম দেবে। বাংলাদেশ তাদের “বীরাঙ্গনা” নামে সম্মান দেয়, যাতে সমাজে কলঙ্ক না লাগে।
মধ্য-১৯৭১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিতে “নির্বাচিত গণহত্যা” শব্দটি আসে। পরে শুধু “গণহত্যা” বলা হয়। আজও অনেকে অস্বীকার করেন—কারণ পুরো বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নয়, নির্দিষ্ট কয়েকটি শ্রেণীকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই শ্রেণীগুলো ছিল জনসংখ্যার বড় অংশ, এবং হত্যার মাত্রা আজকের আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্পষ্টতই “গণহত্যা”।
তাহলে কতজন নিহত? নিশ্চিত সংখ্যা নেই। ২১শ শতকেও নতুন গণকবর মিলছে। বাংলাদেশে “তিন মিলিয়ন” এখন জাতীয় বয়ানের অংশ। হয়তো সংখ্যা বেশি, যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের ২৬,০০০-এর সরকারি সংখ্যা অযৌক্তিকভাবে কম। যুদ্ধশেষে সিআইএ ২ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু অনুমান করে। আজও অনেকে সে সংখ্যা বলেন, কিন্তু তখনো জনমিতি–ভিত্তিক গবেষণা হয়নি, এবং নতুন নতুন কবরও মেলেনি। মার্কিন গবেষক রুডলফ জোসেফ রামেল নিহতের সংখ্যা ১৫ লক্ষ বলে অনুমান করেন।
বিহারি মুসলমানদের মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক আরও বেশি। তারা বিহার থেকে আসা উর্দুভাষী অভিবাসী, যারা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে গিয়ে ভয়ংকর মিলিশিয়া গঠন করেছিল। বিহারি সূত্র বলে—৫ লক্ষ নিহত, যা জনসংখ্যার হিসাবে অসম্ভব। প্রথম বাংলাদেশি সূত্র বলেছিল—১,০০০। বহু গবেষক ২০,000 হিসেবে ধরেছিলেন; রামেল বলেন—হতে পারে ১.৫ লক্ষ পর্যন্ত।
ভারতে পালানো শরণার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি নির্ভুল। ১৯৭১-এর মাঝামাঝি তারা ছিল ৬ মিলিয়ন; যুদ্ধশেষে ৮ মিলিয়ন। দেড় মিলিয়ন ভারতে থেকে যান, বাকিরা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফেরেন। শরণার্থীর এই ঢলই বিশ্বকে গণহত্যার বাস্তবতা বুঝতে বাধ্য করে।