বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৫ - প্রথম হত্যাক্ষেত্র
Categories:
by Massimo Introvigne
পর্ব ৫ / ৮

আগের অংশগুলোতে আমরা দেখেছি—৭ ডিসেম্বর ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস জয়ই ছিল গণহত্যার মূল কারণ। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে নির্বাচিত এই দল জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানিদের অধীনে চলতে রাজি ছিল না। সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান (১৯১৭–১৯৮০) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম দল পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো (১৯২৮–১৯৭৯)—দুজনেই সমাধান খুঁজতে আওয়ামী প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০–১৯৭৫) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।
মুজিব আলোচনা চালালেও ২৩ মার্চ ১৯৭১ তিনি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে উত্তেজিত জনতার সামনে বক্তব্য দেন—তারপরই ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেষ বৈঠকে যান।
তবে আলোচনার আড়ালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফেব্রুয়ারিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—পূর্ব পাকিস্তানকে সামরিক দখলে নেবে। মার্চের শুরুতে বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায় ৩০০ বিহারি নিহত হয়। সেনাবাহিনী পরে এসব ঘটনা হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে দেখালেও এখন জানা যায়—বিহারি দাঙ্গার আগেই সামরিক অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের নথিগুলোর বেশিরভাগই পাকিস্তানে গোপন। তবে ২০০০ সালে কিছু নথি প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে ছিল হামুদুর রহমান কমিশনের আংশিক রিপোর্ট। কমিশনটি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকারই গঠন করেছিল। রিপোর্টটি আন্তর্জাতিকভাবে উপহাসের পাত্র হয়—কারণ তারা দাবি করেছিল বাঙালি নিহত মাত্র ২৮,০০০। এই সংখ্যার দশ গুণ বাড়ালেও কম হতো। তবে নথিগুলো দেখায় সেনাবাহিনী শুরুতে কী ভাবছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল—মাত্র ৩০,০০০ সেনা দিয়ে দুই সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানকে “শান্ত” করা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও তাদের সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করা হবে। আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি সামরিক নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। পূর্ব পাকিস্তান বংশোদ্ভূত সেনাদের নিরস্ত্র করা হবে, কারণ তাদের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ ছিল। সব গণমাধ্যম বন্ধ করে পুরো অঞ্চলকে অস্থায়ী সামরিক প্রশাসনের অধীনে রাখা হবে।
“অপারেশন সার্চলাইট” নামে এই পরিকল্পনা শুরু হয় ২৫ মার্চ ১৯৭১, বিদেশি সাংবাদিকদের দেশছাড়া করার পর। ১০ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। প্রথম দিনই মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। আন্তর্জাতিক চাপে তার প্রাণসংহার ঠেকে যদিও, বছরজুড়ে তিনি কারাগারেই ছিলেন। তবে মুজিবের গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের সতর্ক করে দেয়। অনেকেই ভারতে পালিয়ে যান, কেউ কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ব পাকিস্তানের সেনারা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের এক বাঙালি-নিয়ন্ত্রিত রেডিও থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়—বন্দী মুজিবের নামেই। এতে বাঙালির মনোবল আরও দৃঢ় হয়। সেদিনই সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে, তবে ততক্ষণে প্রায় ৪০০ ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে। শত শত ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন।
পূর্ব পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্রীকরণে বাধা দেয়। হাজারো সেনা নিহত হয় অভিযানের প্রথম কয়েক দিনে। ১০ এপ্রিল নাগাদ সেনাবাহিনী ঢাকা ও বড় শহরগুলো দখলে নিলেও চট্টগ্রামে প্রতিরোধ ছিল। রাজশাহী, সিলেটসহ মাঝারি শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিরাট অংশ তখনো আওয়ামীপন্থী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
অভিযান শেষ হওয়ার বদলে ১০ এপ্রিল ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা হয়। মুক্তিবাহিনীও আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়।许运 িকভাবে সরকার গঠিত হয় আগরতলায়—যে শহরকে পাকিস্তান সরকার একসময় “ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র” বলেছিল। ১৭ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে, বৈদ্যনাথতলায় (স্বাধীনতার পর নাম হয় মুজিবনগর) শপথ হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও আক্রমণাত্মক। সেনা বাড়িয়ে সংখ্যা প্রায় এক লাখে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেক বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—আওয়ামী বিরোধী পূর্ব পাকিস্তানি গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র দেওয়া। এরা ছিল বিহারি মুসলমান এবং ইসলামি মৌলবাদী দলগুলো, বিশেষ করে জামাত-ই-ইসলামির সদস্যরা। পরবর্তী মাসগুলোতে এই মিলিশিয়ারা সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার অংশ হয়। স্বাধীনতার পর প্রতিশোধে হাজারো বিহারি ও জামাত সদস্য নিহত হয় বাংলাদেশিদের হাতে।
এই মিলিশিয়াদের ব্যবহারই ছিল নতুন পরিকল্পনার অংশ—পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এক নির্মূল যুদ্ধ। এই গণহত্যা কীভাবে চলেছিল, তা আমরা পরবর্তী অংশে আলোচনা করব।