বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৪ - ১৯৭০, সিদ্ধান্তের বছর
Categories:
by Massimo Introvigne
পর্ব ৪ / ৮

আগের অংশে আমরা দেখেছি পাকিস্তান সরকারের নানা কৌশল। পশ্চিম পাকিস্তান-শাসিত সরকার চেয়েছিল আওয়ামী লীগকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঠেকাতে। জনসংখ্যা-পরিসংখ্যান তাদের পক্ষে ছিল না, কারণ পূর্ব পাকিস্তানে ভোটারের সংখ্যা ছিল বেশি।
আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আবার পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর (১৯২৮–১৯৭৯) সমাজতান্ত্রিক পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতৃত্বে নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়। সামরিক শাসন থাকলেও নির্বাচন বাতিল করা তখন আর মুশকিল ছিল।
এরপর প্রকৃতি আঘাত হানে। ১৯৭০ সাল পাকিস্তানের জন্য ভয়াবহ বছর। শুরুতেই বন্যায় হাজারো প্রাণহানি। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান (১৯১৭–১৯৮০) ১৫ আগস্ট ঘোষণা করেন যে ৫ অক্টোবরের নির্বাচন পিছিয়ে ৭ ডিসেম্বর করা হবে।
অনেকে মনে করতেন এটি সময় কেনার চেষ্টা। ইয়াহিয়া পুরো নির্বাচনই বাতিলের পথ খুঁজছিলেন। তবে দুর্যোগ বাস্তব ছিল। অক্টোবরের দুই ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬,০০০ মানুষ মারা যায়। এরপর ১২ নভেম্বর ১৯৭০-এর ভোলা সাইক্লোন। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। আধুনিক যুগের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর একটি। পূর্ব পাকিস্তানে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। পুরো গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়। লাখো মানুষ ঘর-বাড়ি ও জীবিকা হারায়।
আগের বিতর্কের কারণে নির্বাচন আর পিছানো গেল না। বরং ভোলা সাইক্লোনই নির্বাচনের মূল আলোচ্য হয়ে ওঠে। ত্রাণ ছিল ধীর ও অপর্যাপ্ত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাস করল—এও সেই পুরনো অবহেলা। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক নয়।
৭ ডিসেম্বর ১৯৭০-এ সাধারণ নির্বাচন হয়। উপকূলের নয়টি জেলায়, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থার কারণে ভোট হয় ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১-এ। ধ্বংসযজ্ঞের পরও ভোট উপস্থিতি ছিল ৬৩%। প্রত্যাশিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে ভোট বেশি পড়ে। ইতিহাসবিদদের মতে পাকিস্তানের সবচেয়ে সুষ্ঠু এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জয়ী হয়। তারা ১৬৭টি আসন পায়—পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব আসন, মাত্র দুইটি বাদে। ৩১৩ আসনের জাতীয় পরিষদে এটি ছিল পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি দ্বিতীয় স্থানে, মোট ৮৬ আসন। জামাত-ই-ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোও কিছু আসন পায়।
সকল ভ্রম ভেঙে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন সত্যি হলো। জাতীয় পরিষদ বসলেই আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করবে। তখন তারা শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, পশ্চিম পাকিস্তানও শাসন করবে। আগের অংশে যেমন উল্লেখ করেছি—এটি বেশির ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানির কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খান অন্যান্য বিষয়ে মতভেদ থাকলেও একটি বিষয়ে এক—আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে তারা বাধা দেবে। আওয়ামী প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০–১৯৭৫) বা মুজিব যেন প্রধানমন্ত্রী না হন।
১৫ জানুয়ারি ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে। তিনি প্রস্তাব দেন—জাতীয় পরিষদ বসবে ৩ মার্চ। মুজিব প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, কিন্তু ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতি থাকবেন পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কিন্তু ভুট্টো এতে রাজি নন। তিনি ১৯৭০-এর লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (LFO) ব্যাখ্যা করে বলেন—শুধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে না। তাই তিনিই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত।
মুজিব-ভুট্টো বৈঠকে কোনো সমাধান হয় না। ইয়াহিয়া পরিষদের প্রথম অধিবেশন পিছিয়ে দেন, যতক্ষণ না উভয়পক্ষ তারিখে একমত হন।
এদিকে আরেক জটিলতা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব জনপ্রিয় হলেও সবাই তার পক্ষে ছিল না। ইসলামি মৌলবাদীরা, বিশেষ করে জামাত-ই-ইসলামির সদস্যরা, ধর্মকে ভাষা বা জাতিগত পরিচয়ের থেকেও বড় মনে করতেন। তারা মুজিবকে “ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান” হিসেবে দেখে বিরোধিতা করতেন। পাশাপাশি কিছু ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘুও ছিল, যারা নিজেদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছাকাছি ভাবত।
তাদের মধ্যে ছিল ৫–১০ লাখ বিহারি মুসলমান। ভারতের বিহার থেকে ১৯৪৭-এর দেশভাগে তারা পূর্ব পাকিস্তানে আসে। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতাও করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এলে বঞ্চনার আশঙ্কায় মার্চের প্রথম সপ্তাহে তারা রাস্তায় নামে। তারা দাবি করতে থাকে—আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া যাবে না। এতে বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। প্রায় ৩০০ বিহারি নিহত হয়।
৭ মার্চ মুজিব ঘোষণা করেন—এটি এখন “স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তবুও তিনি ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা রাখেন। ১৫ ও ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া আবার ঢাকায় এসে মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু মুজিবকে তিনি বলেননি—পশ্চিম পাকিস্তান অধ্যুষিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই এক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য এসে পূর্ব পাকিস্তান দখল করবে, সামরিক শাসন দেবে, এবং আওয়ামী নেতাদের গ্রেপ্তার করবে। তখন কেউ জানত না—ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের মাত্র দশ দিন পরই শুরু হবে গণহত্যা।