বাংলাদেশ গণহত্যা. পর্ব ৩ - বাঙালি নেতাদের দমন অভিযান

১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯—এই সময়ে আইয়ুব খানের শাসন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তারা ব্যর্থ হয়, কিন্তু পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়।

by Massimo Introvigne

পর্ব 3/8

বাংলাদেশ গণহত্যা. পর্ব ৩ - বাঙালি নেতাদের দমন অভিযান

আগের লেখাগুলোতে আমরা দেখেছি—পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে সংকট ছিল অমীমাংসিত। অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ভাঙলে পশ্চিমেও অস্থিরতা তৈরি হতো। কিন্তু নির্বাচন সত্যি হলে জনসংখ্যার কারণে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পুরো দেশ শাসন করতে পারত, যা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা একচেটিয়াভাবেই শেষ করে দিত।

সমস্যা আরও জটিল ছিল কারণ পশ্চিমে বহু সংগঠিত রাজনৈতিক দল থাকলেও পূর্বে কার্যত একটিই প্রভাবশালী দল—আওয়ামী লীগ। ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা মুসলিম লীগের বিরোধ করে দলটি গঠন করেন। মুসলিম লীগ তখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে ছিল।

দলের তিনজন যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০–১৯৭৫), সবার পরিচিত ‘মুজিব’, দ্রুতই প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের জনক হন। ১৯৭৫ সালে তাকে হত্যা করা হয়। তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা বর্তমান বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী।

মুজিব ভাষা আন্দোলনেরও অন্যতম মুখ ছিলেন। ১৯৪৮ সালে এই কারণে তাকে তিনবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫০–৫২ সালে আবার দুই বছর কারাবন্দি থাকেন, বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর মিলনচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি পূর্ব বাংলা সরকার এবং পাকিস্তানের গণপরিষদ—উভয়ের সদস্য হন।

আইয়ুব খানের সামরিক শাসন এলে মুজিব আবারও গ্রেফতার হন—১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করেন। এটি ছিল ফেডারেল পাকিস্তানের মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের দাবি—যার কথা আগের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ছয় দফা বাঙালিদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের চোখে এটি ছিল গোপন বিচ্ছিন্নতার রূপরেখা। জাতীয় নির্বাচনের দাবি বাড়তে থাকলে আইয়ুব সরকার ঠিক করল— আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের আগেই দুর্বল করতে হবে। মুজিবকে সরাতে হবে।

তারা ব্যবহার করল গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাকে। ডিসেম্বর ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। গণমাধ্যম মতে সফর স্বাভাবিক ছিল। তবে দেশে ফিরেই গোয়েন্দারা দাবি করল—বাঙালি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। প্রমাণ অপ্রতুল হলেও ৬০ জন নেতা ও সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে মার্কিন তদন্তে প্রকাশ পায়—এমন কোনো হত্যাচেষ্টা ছিল না।

তবুও পাকিস্তানের আইএসআই দাবি চালিয়ে যায়—ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র বিদ্রোহের অংশ হিসেবে আইয়ুবকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এটিকে বলা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’— অভিযোগ ছিল, বাঙালি নেতারা ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছে। ১,৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মুজিবও ছিলেন তাদের মধ্যে। তবে আদালতে তোলা হয় মাত্র ৩৫ জনকে। উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ ও মুজিবকে ধ্বংস করা। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো (১৯২৮–১৯৭৯) নতুন দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করেছেন, ফলে নির্বাচন অনিবার্য হয়ে উঠছিল।

পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে। আওয়ামী লীগের কেউ ভারতের সঙ্গে কথা বলেছিল—এটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ বা সহিংসতার কোনো দৃঢ় প্রমাণ ছিল না।

এদিকে চলছিল আগরতলা মামলা। শুরু হয়েছিল ১৯ জুন ১৯৬৮। মামলা চলাকালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯—বন্দী আসামি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক (১৯৩৫–১৯৬৯) এক প্রহরীর গুলিতে নিহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবারও প্রথমে প্রতিবাদে নামে। পরে লাখো বাঙালি রাস্তায় নামে। রাজশাহীতে প্রতিবাদে যোগ দেওয়া শিক্ষক মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা (১৯৩৪–১৯৬৯) পুলিশ গুলিতে নিহত হন।

অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার জানায়—আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সকল আসামি মুক্তি পান। ঢাকায় লাখো মানুষ মুজিবকে অভ্যর্থনা জানান। তাকে দেওয়া হয় খেতাব—“বঙ্গবন্ধু”—অর্থাৎ “বঙ্গের বন্ধু”।

আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের পরিকল্পনা উল্টো আইয়ুব সরকারের জন্য বিপর্যয় হয়ে দাঁড়ায়। দলটি ধ্বংস না হয়ে বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

কিন্তু আইয়ুব খানকে গোয়েন্দারা ভুল তথ্য দেয়। বলা হয়—আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে গেছে, নির্বাচনে জিতবে না। তাই তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন ঘোষণা করেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল—হার্ট অ্যাটাক ও পক্ষাঘাতে তিনি হুইলচেয়ারে চলে গিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানকে (১৯১৭–১৯৮০), যিনি সম্ভবত আগে থেকেই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন।

তবুও নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। একে আর থামানোর কোনো উপায় ছিল না।