বাংলাদেশ গণহত্যা. পর্ব ২ - ভাষা আন্দোলন

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাইছিলেন বাংলা যেন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষাগুলির একটি হয়। রক্তাক্ত দমন-পীড়নের পর, ১৯৫৬ সালে তারা এই দাবিতে জয় পান।

by Massimo Introvigne

পর্ব 2/8

বাংলাদেশ গণহত্যা. পর্ব ২ - ভাষা আন্দোলন

১৯৪৮ সালের মার্চে, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, আধুনিক পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬–১৯৪৮) পূর্ব বাংলায় আসেন। তিনি ঘোষণা করেন—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল সাংস্কৃতিক যুক্তি। কারণ, মুঘল আমল থেকে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে উর্দু ছিল ঐক্যের প্রতীক।

তবে বাংলার মুসলমানরা ছিলেন ব্যতিক্রম। বাংলার ছিল সমৃদ্ধ সাহিত্য ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। তাই তারা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করতে চাননি। ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্থানের সময় থেকেই বাঙালিরা দাবি করতেন—উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও মুসলিম সংগঠনগুলোর সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ১৯শ শতকের ‘বাঙালি রেনেসাঁ’ বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়—হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের মধ্যেই। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের ৫৪% নাগরিকের ভাষাও ছিল বাংলা।

তারপরও জিন্নাহ উর্দুকেই বেছে নিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে এটি দেখা হয়েছিল পশ্চিমের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল হিসেবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সফরেই জানালেন—উর্দু ছাড়া আর কোনও ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না। ভিন্নমতের মানুষকে তিনি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দোসর বলেও আক্রমণ করলেন।

জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসার সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইতিমধ্যেই উর্দু আরোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছিল। জিন্নাহ ২১ মার্চ ঘোষণা দেন এবং ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বক্তব্য রাখেন। ছাত্ররা বারবার বাধা দেওয়ায় তিনি কষ্টে বক্তব্য শেষ করেন।

পরের কয়েক মাসে জিন্নাহর যক্ষ্মা ধরা পড়ে এবং পরে ফুসফুসের ক্যান্সারও শনাক্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। ভাষা-দাবি ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়।

পূর্বের মানুষ আশা করেছিল নতুন নেতৃত্ব ভাষা প্রশ্নে নমনীয় হবে। কিন্তু ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের গণপরিষদ আবারও জানাল—রাষ্ট্রভাষা শুধু উর্দুই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকা জ্বলে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে পাঁচ ছাত্র (সম্ভবত আরও বেশি) শহীদ হন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘ ঘোষণা করে।

২২ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলন সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। আরও মানুষ নিহত হন। সরকার আবারও ভারতের ও সোভিয়েতের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তুলে ধরল। ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে ঢাকায় একটি সাময়িক স্মৃতিস্তম্ভ গড়া হয়, যা ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ভেঙে ফেলে। হাজারো মানুষ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ, গ্রেফতার হন।

এক বছর পর, ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় লাখো মানুষের সমাবেশ হয়। শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতেও স্মরণানুষ্ঠান চলতে থাকে।

ধীরে ধীরে বাঙালিরা জয় অর্জন করে। ১৯৫৪ সালের মধ্যে গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দাঁড়ান। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এটি বাস্তবায়িত হয়। মিলনের বার্তা দিতে সরকার শহীদ মিনার নির্মাণেও সহায়তা করে।

তবে এই পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা বেশিদিন টেকেনি। ভাষা-আন্দোলনের সাফল্যের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বিভক্ত হন—কেউ পাকিস্তান থেকে আলাদা স্বাধীনতা চান, কেউ চান স্বায়ত্তশাসন ও শক্তিশালী ফেডারেল কাঠামো।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের (১৯০৭–১৯৭৪) সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান বাতিল হয়। সেনাবাহিনীর কিছু অংশ আবারও উর্দু-একভাষার পক্ষে মত দেয়। তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে রয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা আবারও কারাবন্দি হন।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধ শুরু হয় কাশ্মীর নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তান অভিযোগ করল—তাদের সম্পদ পশ্চিমের যুদ্ধেই শেষ হয়েছে, সীমান্ত রক্ষাই হয়নি, আর ক্ষমতা থেকেও তারা বঞ্চিতই রয়ে গেছে।

১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফা দাবি’ ঘোষণা করে। এতে বলা হয়—পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। কেন্দ্র শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দেখবে। অন্য সব ক্ষমতা রাজ্যগুলোর হাতে থাকবে। এটি বিচ্ছিন্নতার দাবি ছিল না। তবুও আইয়ুব খান এবং নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান (১৯১৭–১৯৮০) আওয়ামী লীগকে “বিচ্ছিন্নতাবাদী” বলে আক্রমণ করেন। ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করেন—প্রয়োজনে তিনি গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। শেষ পর্যন্ত সেই হুমকি সত্যিই বাস্তবতা হয়ে ওঠে।