বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ১ – “পূর্ব পাকিস্তান” এর সন্ধানে
Categories:
by Massimo Introvigne
পর্ব 1/8

২০২১ সাল ছিল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যার ৫০ বছর পূর্তি—যা ২০শ শতকের সবচেয়ে নৃশংস অথচ সবচেয়ে উপেক্ষিত অধ্যায়গুলোর একটি। বিশেষ করে ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নতুন করে হামলা শুরু হওয়ায় এ দিবসটি আরও বেদনাদায়ক ও অশুভ হয়ে ওঠে।
গণহত্যা ঘটেছিল ১৯৭১ সালে, কিন্তু এর শিকড় অনেক পুরোনো। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হল মুসলিম ঐতিহ্যবাদী ও মৌলবাদীদের অভিযোগ যে অধিকাংশ বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান নাকি “গোপন হিন্দু।” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো—যারা নিপীড়ন এড়াতে নিজেদের মুসলমান (বা খ্রিস্টান) বলে পরিচয় দেয়—কিন্তু পরে এটি হয়ে ওঠে সুফি ও লোকধারার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অপমানসূচক শব্দ, কারণ তাদের কিছু আচরণ মৌলবাদীদের চোখে “অর্থডক্স” অনুযায়ী ছিল না। তারা মাঝে মাঝে হিন্দু বা শিখ ধর্মস্থলেও যেতেন।
বর্তমান বাংলাদেশের অঞ্চলে এই ধরনের ইসলাম ছিল প্রচলিত, যদিও তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীও সক্রিয় ছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দেয় (যদিও প্রথমে ডমিনিয়ন রূপে)। তাঁদের ধারণা ছিল—হিন্দু-মুসলিম বিরোধ বাড়তে থাকলে একক ভারত রাখা গেলে গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যা হবে। সমাধান হিসেবে তাঁরা করলেন দেশভাগ—হিন্দুদের জন্য ভারত এবং মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ জায়গায় থাকার কথা থাকলেও ১ থেকে ২ কোটি মানুষ দেশভাগে চলে আসেন—কারণ তাঁরা এমন দেশে থাকতে চাননি যেখানে তাঁদের ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। তবুও অনেকেই থেকে যান। আজও ভারতে ২০ কোটির বেশি মুসলমান, পাকিস্তানে কমপক্ষে ৪ মিলিয়ন হিন্দু (হিন্দুরা দাবি করেন প্রকৃত সংখ্যা ৮ মিলিয়নের কাছাকাছি), এবং বাংলাদেশে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি হিন্দু বসবাস করেন।
পাকিস্তান গঠিত হয় এক অদ্ভুত রাষ্ট্র হিসেবে—একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) এবং অন্যদিকে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)—একই সরকারের অধীনে, কিন্তু দুটির মাঝে ছিল ১৭০০ কিলোমিটার দূরত্ব ও মাঝখানে ছিল ভারত। এর সীমানা তৈরিতে রেফারেন্স নেওয়া হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে—যা ১৯১১ সালে বাতিল হলেও ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার ভিত্তি নির্ধারণে কাজে লাগে।
দেশভাগে দুটি বড় সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, এটি ব্রিটিশদের আশা মতো শান্তিপূর্ণভাবে ঘটেনি। কোটি কোটি মানুষের পুনর্বাসন সৃষ্টি করে উত্তেজনা, লুট, হত্যাকাণ্ড। অনেকেই থাকতে চাইলেও ভিন্ন ধর্মের দাঙ্গাবাজদের হাতে আক্রান্ত হন, পালাতে বাধ্য হন বা নিহত হন। বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও ধারণা করা হয়—দেশভাগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায়।
পূর্ব বাংলাতেও সহিংসতা ছড়ায়, যেখানে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর ওপর হামলা চালায় মুসলিম দাঙ্গাবাজরা। ব্রিটিশদের সীমারেখা তৈরি ছিল অগোছালো। ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু অধ্যুষিত খুলনা জেলা পাকিস্তানের অংশ হয়, আর কিছু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা যায় ভারতের অন্তর্ভুক্ত।
ভৌগোলিক কারণে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলও পূর্ব বাংলার হাতে আসে—যেখানে বৌদ্ধ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং হিন্দুরাও ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার দিনে সেখানকার বৌদ্ধ ও হিন্দুরা ভারতীয় পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন—তাঁরা ভাবতেন তাঁরা ভারতের অংশ। দুই দিন পর তাঁদের জানানো হয়—তারা পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেছেন। বিদ্রোহের চেষ্টা হলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অঞ্চলটি দখল করে এবং ঘটে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, নির্যাতন।
দ্বিতীয় সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অনেক গরিব ছিল। পশ্চিমারা তাদেরকে “পিছিয়ে পড়া” এবং পুরোনো অভিযোগ অনুসারে “খারাপ” মুসলমান মনে করত। আবার জনসংখ্যাগত ভারসাম্যও দ্রুত বদলে যায়। ১৯৪৭ সালে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান উভয়ের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বেড়ে যায় অভিবাসন এবং জন্মহার বৃদ্ধির ফলে। ১৯৭১ সালে বিহারি মুসলমানরা হবে গণহত্যার উভয়ই— অভিনেতা এবং শিকার। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটি ২০ লাখ, আর পশ্চিম পাকিস্তানের ৩ কোটি ৩৭ লাখ।
রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র ও সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে ছিল। কিছু বাঙালি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হলেও তাদের সময়কাল ছিল স্বল্প এবং প্রায়ই তাঁদের উৎখাত করা হয় সামরিক অভ্যুত্থানে। সামরিক বাহিনীর উচ্চপদে পূর্বাঞ্চলীরা ছিল গণনাযোগ্য সংখ্যালঘু।
এতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ গণতান্ত্রিক সরকার চাইতেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভোট হলে পূর্ব পাকিস্তানের আসন বেশি, এবং সেখানে আওয়ামী লীগ ছিল প্রধান শক্তি। সুতরাং যেকোনো প্রকৃত নির্বাচন আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেবে—ফলে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানকে শাসন করবে দরিদ্র পূর্ব পাকিস্তান। এই কারণে দেশটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন এড়িয়ে চলে—অবশেষে ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়, এবং তার ফলেই শুরু হয় গণহত্যার দিকে অগ্রযাত্রা।