কাপ্তাই হ্রদের তলায় লুকিয়ে থাকা চাকমা রাজবাড়ির ইতিহাস

কাপ্তাই হ্রদের তলায় লুকিয়ে থাকা চাকমা রাজবাড়ির ইতিহাস

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের পানির নিচে আজও লুকিয়ে আছে চাকমা রাজার প্রাচীন রাজপ্রাসাদ, যা একসময় চাকমা রাজাদের শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ১৯৬০ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে রাজবাড়িটি ডুবে যায়, যা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য বেদনার প্রতীক হয়ে আছে। চাকমা রাজার নতুন রাজপ্রাসাদ তৈরি হলেও ডুবে থাকা ঐতিহাসিক প্রাসাদটি দেখতে বিভিন্ন সময়ে মানুষের ভিড় জমে কাপ্তাই হ্রদের তীরে। এই প্রাসাদ পাহাড়ি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একটি অনন্য স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।

রাঙামাটি, ৮ নভেম্বর ২০২৪: রাঙামাটি শহরের জেলা প্রশাসকের বাসভবনের পাশেই কাপ্তাই হ্রদের তীরে এক বিশেষ স্থান আছে, যেখানে প্রায়শই মানুষের ভিড় দেখা যায়। কেউ কেউ নৌকা নিয়ে হ্রদের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় চলে যান এবং নিচের জলে চোখ রাখেন। তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিচের জলরাশির তলায় থাকা চাকমা রাজার প্রাচীন রাজপ্রাসাদ, যা কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কারণে আজও জলের নিচে চাপা পড়ে আছে।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করলে হাজারো বাড়িঘরের সাথে চাকমা রাজবাড়িও পানির নিচে ডুবে যায়। এই হ্রদ সৃষ্টির সময় লাখো মানুষ স্থানচ্যুত হন, যাঁদের কাছে এই ডুবন্ত রাজবাড়ি যেন অতীতের হারানো ইতিহাসের এক দুঃখময় স্মৃতিচিহ্ন। এমনকি পানি যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়, তখন হ্রদের নিচে লুকিয়ে থাকা প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ কিছুটা দৃশ্যমান হয়, যা দেখতে ভিড় করেন স্থানীয় ও আগ্রহী দর্শনার্থীরা।

চাকমা রাজাদের আদি রাজপ্রাসাদটি ছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। রাঙ্গুনিয়া থেকে রাঙামাটিতে আসেন রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়, এবং এখানেই প্রায় ৮৪ বছর ধরে তিনি রাজকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে সেই প্রাসাদ ডুবে যায়। বর্তমানে রাঙামাটি শহরে নতুন চাকমা রাজবাড়ি নির্মাণ করা হলেও প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আজও জলের নিচে রয়ে গেছে, যা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে আছে।

চাকমা সার্কেল কার্যালয়ের কর্মকর্তা সুব্রত চাকমা জানান, কাপ্তাই বাঁধের ফলে রাজবাড়ির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহারও ডুবে গেছে। সেখানে থাকা বিশাল বুদ্ধমূর্তি আজও রয়ে গেলেও মন্দিরটি বিলীন হয়ে গেছে। পুরোনো রাজপ্রাসাদ থেকে একটি প্রাচীন কামান উদ্ধার করে তা বর্তমান চাকমা রাজার কার্যালয়ের পাশে রাখা হয়েছে।

অতীত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী নিরূপা দেওয়ান বলেন, “আমি ছোটবেলায় রাজ পুণ্যাহ দেখতে সেখানে যেতাম। সে সময় অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর সেই রাজবাড়িটি দেখে অভিভূত হতাম। কখনো ভাবিনি সেই বাড়ি পানির নিচে চলে যাবে।”

১৯৮৬ ও ২০০৬ সালে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গেলে রাজবাড়িটির কিছু অংশ ভেসে ওঠে। সেই সময় অনেকে রাজবাড়ির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ইট তুলে নিয়ে আসেন। এ রাজপ্রাসাদ আজও চাকমা জনগোষ্ঠীর অতীত এবং তাদের বেদনার এক চিরস্মরণীয় প্রতীক হয়ে আছে, যা পাহাড়ি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারক হিসেবে রয়ে গেছে।

তারিখ ০৯.১১.২০২৪