পাঁচ শতাধিক বছরের ঐতিহ্য বহন করছে নাটোরের বুধপাড়া কালীপূজার মেলা

পাঁচ শতাধিক বছরের ঐতিহ্য বহন করছে নাটোরের বুধপাড়া কালীপূজার মেলা

প্রতি বছর কার্তিক মাসে নাটোরের লালপুর উপজেলার বুধপাড়া গ্রামে কালীপূজাকে ঘিরে জমে ওঠে এক ঐতিহ্যবাহী মেলা, যা স্থানীয় হিন্দু-মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। প্রাচীন এই মেলার সূচনা হয়েছিল ৫৩৫ বছর আগে, যা এখনও অঞ্চলটিতে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে। মেলায় কাঁসার তৈজসপত্র, কাঠের আসবাব, মিষ্টির দোকানসহ নানা পণ্যের সমাহার ঘটে। কালীমন্দিরের পাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই মেলা বসে, যা স্থানীয় ও বিদেশি দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। এবছর মেলা শুরু হয়েছে এবং চলবে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত।

নাটোর, ১ নভেম্বর ২০২৪: কার্তিক মাস এলেই নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার বুধপাড়া গ্রামে উৎসবের আমেজ শুরু হয়। বিশেষ করে মেয়ের বাড়ি জামাতা ও নাতি-নাতনিদের আগমনে বাড়ির পরিবেশ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। অতিথি আপ্যায়নের জন্য বাড়ির গৃহিণীরা নাড়ু-মুড়ি ও মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রতি বছর এই উৎসবটি মূলত বুধপাড়ার কালীপূজা ও মেলাকে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হয়।

বুধপাড়া গ্রামে শুরু হওয়া এই মেলা এখন কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং হিন্দু-মুসলিমসহ সকল ধর্মের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এবছর মেলা শুরু হয়েছে গত বৃহস্পতিবার থেকে এবং চলবে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলার ইতিহাস ৫৩৫ বছর পেছনে, ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে, যখন এখানকার কাঁসাশিল্পীরা এই মেলার সূচনা করেন। নবাবি আমলের বর্গি হাঙ্গামার সময় ভারতের মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের খাগড়া থেকে কাঁসাশিল্পীদের এক বড় দল এখানে বসতি গড়ে এবং মেলার গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে জমিদার পুণ্যচন্দ্র দাস প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমি দান করে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা করেন।

বুধপাড়ার কালীমন্দির চত্বরে মেলা বসে, এবং প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মেলার প্রসার ঘটে। মেলার প্রথম দিনে ক্রেতাদের মধ্যে শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি ছিল। তারা জিলাপি, সন্দেশসহ বিভিন্ন মিষ্টি কিনতে ব্যস্ত ছিল। এক মিষ্টির দোকানের নাম ‘নিত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভান্ডার’। দোকানের মালিক জিতেন দাস বলেন, তাঁদের মিষ্টির ব্যবসা প্রায় শতবর্ষ ধরে চলছে। তার পূর্বপুরুষ ললিন দাস বেতের ঝুড়িতে করে হেঁটে সন্দেশ বিক্রি করতেন। এবছরের মেলায় জিতেন আশা করছেন সাত দিনে অন্তত ২০ মণ মিষ্টি বিক্রি করতে পারবেন। মেলার প্রায় ৮০ ভাগ ক্রেতাই মুসলিম সম্প্রদায়ের, তাই ব্যবসায় মন্দা হয় না বলে জানান তিনি।

মেলায় শুধু মিষ্টিই নয়, কাঠের আসবাব, চাদর, কম্বল, ও শিশুদের খেলনাসামগ্রীসহ নানা ধরনের পণ্য বিক্রি হয়। মেলার মূল আকর্ষণ ঐতিহ্যবাহী কাঁসার তৈজসপত্র, যা স্থানীয়রা পুরোনো স্মৃতিকে ধরে রাখতে কিনে থাকেন। কাঁসাশিল্পীদের হাতে গড়া এসব সামগ্রী কেনার জন্য মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন।

মেলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হল শিশুদের জন্য নানা ধরনের খেলার উপকরণ। নাগরদোলা ও বিভিন্ন খেলনার কারণে মেলায় শিশুদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া মেলায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্য বিশেষভাবে ভোগ ও বলির পাঁঠার মাংস বিতরণের ব্যবস্থা থাকে। প্রতি দিন ৫০-৬০টি পাঁঠা বলি দিয়ে তার মাংস বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়।

বুধপাড়া মেলার সঙ্গে সম্পর্কিত মন্দিরের পুরোহিত সুবোধ কুমার মজুমদার জানান, এখানে যে কালী প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে তা দৈর্ঘ্য ও উচ্চতায় দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রতিমা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এমনকি ভারত ও নেপাল থেকেও বহু দর্শনার্থী বুধপাড়ার এই মেলায় আসেন শুধু প্রতিমা দর্শনের উদ্দেশ্যে। বিশাল এই প্রতিমার সৌন্দর্য্য ও মহিমা বিদেশি দর্শনার্থীদেরও আকৃষ্ট করে।

বুধপাড়া গ্রামের একজন ষাটোর্ধ বাসিন্দা আজিজুর রহমান বিশ্বাস বলেন, মেলা উপলক্ষে তাঁর বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে অতিথিরা আগমন করেন। তাঁদের জন্য প্রস্তুত করা হয় বিশেষ খাবার, যেমন তিল-নারকেলের নাড়ু, তিলের খাজা ও বিভিন্ন মিষ্টান্ন। বুধপাড়ার বাসিন্দা বিচ্ছাদ আলীর বাড়িতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা অতিথিদের মেলা ঘুরতে দেখা যায়। মেলাকে কেন্দ্র করে এখানকার বিভিন্ন বাড়িতে আগতদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

বিকেল বেলার দিকে মেলায় দর্শনার্থীদের ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে। মেলার রাস্তার ধারে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে এবং নতুন দোকানগুলোও স্থাপিত হচ্ছে। এভাবে প্রায় পাঁচ শতাধিক বছরের ঐতিহ্য বহন করা বুধপাড়া কালীপূজার মেলা আজও এলাকাবাসীর জন্য অসাম্প্রদায়িক উৎসবের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে গেছে।

তারিখ ০৯.১১.২০২৪