বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে উচ্চ আদালতে চলছে বিতর্ক। সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে এটিকে পুনরায় পর্যালোচনার দাবি উঠেছে। এতে সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে, যা দেশের ৯০ শতাংশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষাপটে ‘আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপনের পক্ষপাত করছে। তবে এই প্রস্তাবকে নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। (সূত্রঃ ডয়চে ভেলে)
ঢাকা, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪: ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস হয়। এতে ১৯৭২ সালের সংবিধানের বেশ কিছু বিষয় পুনঃস্থাপিত হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং প্রস্তাবনায় বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম যুক্ত থাকে। তবে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের উল্লেখ বাদ দেওয়া হয়। বর্তমানে এটিকে পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব উঠে আসায় বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
এক শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্র’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, “দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। আমরা চাই, সংবিধানে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস পুনরায় স্থাপন করা হোক।”
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০ এ উন্নীত হয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল ৭ অনুচ্ছেদের পর ৭(ক) এবং ৭(খ) অনুচ্ছেদ সংযোজন, যা সংবিধানবহির্ভূত পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল রোধে কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে যুক্ত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, ‘‘রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা রাখা উচিত। সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকায় ইতিমধ্যে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। নাগরিকরা নিজেদের ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্রের কাজ হলো সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।’’
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘সংবিধানে একদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা হয়েছে, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। এটি সোনার পাথরবাটির মতো।’’ তিনি মনে করেন, ‘‘যদি একটি ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে অন্য ধর্মের অনুসারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়বেন।’’
সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘‘ধর্ম এবং সংবিধান দুইটি আলাদা বিষয়। সংবিধান দিয়ে কেউ ধর্মীয় পরিচয় নির্ধারণ করে না। এটি জনগণের উপর নির্ভরশীল যে তারা সংবিধানে কী চান।’’
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘‘পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোপুরি অবৈধ এবং এটিকে বাতিল করা উচিত। বাতিল হলে সংবিধানের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিত।’’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘‘আমরা এমন কোনো সংশোধনী চাই না, যা কোনো ধর্মের মানুষকে বৈষম্যের শিকার করে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মুসলমান হলেও অন্য ধর্মের মানুষও এই দেশের সমান নাগরিক।’’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। এটি দেশের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দ বাদ দেওয়া এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব যে ভবিষ্যতে দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, তা সময়ই বলে দেবে।
তারিখ: ১৭.১১.২০২৪