মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মণিপুরি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব মহারাসলীলার আয়োজন করা হয় জোড়া মণ্ডপে। পূর্ণিমার রাতে শুরু হওয়া এ উৎসব ছোটদের গীতনৃত্য থেকে শুরু করে রাতভর শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার লীলার পরিবেশনার মাধ্যমে দর্শকদের বিমোহিত করে। এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবে দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মেলা, আলোচনাসভা ও নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থায় উৎসবটি সুষ্ঠুভাবে উদযাপিত হয়।
মৌলভীবাজার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মণিপুরি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলার মহোৎসবে শুক্রবার হাজারো ভক্ত ও দর্শকের ঢল নামে। মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে ও আদমপুর গ্রামে আয়োজিত এ উৎসবে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার লীলাকে গীতনৃত্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন স্থানীয় শিল্পীরা।
শুক্রবার সকালে মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, মণিপুরি ছোটদের গীতনৃত্য ও আলপনায় সাজানো মণ্ডপ ভক্ত ও দর্শকদের প্রাণবন্ত করে তুলেছে। দিনের প্রথম পর্বে শ্রীকৃষ্ণর শিশুকাল ও বাল্যকালের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়।
রাতভর মহারাসলীলা
সন্ধ্যার আলোচনাসভা শেষে রাতভর চলা মহারাসলীলার মূল পরিবেশনায় রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে নৃত্য ও গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন শিল্পীরা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার রূপায়ণ দর্শকদের বিমোহিত করে।
মাধবপুর মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সহসভাপতি লক্ষ্মণ সিংহ জানান, প্রায় এক মাস ধরে এ উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবির বিশেষ তৎপরতা ছিল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মণিপুরি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা শুভাশিস সিনহা মহারাস উৎসবের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, “১৭৭৯ সালে মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের স্বপ্নাদেশে কাঠের কৃষ্ণমূর্তি নির্মাণ করেন। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই অগ্রহায়ণের শুক্লাপূর্ণিমায় মহারাসলীলা উৎসবের সূচনা হয়। সেই থেকে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।”
গীত-নৃত্যের বৈচিত্র্য
উৎসবের গানে জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তাদের রচিত বাংলা, ব্রজবুলি, মৈথিলী ও সংস্কৃত ভাষার পদাবলির সংমিশ্রণ দেখা যায়। সম্প্রতি মণিপুরি ভাষায়ও রচিত হচ্ছে মহারাসের গান। শুভাশিস সিনহা জানান, উৎসব আয়োজনে এখন আধুনিকায়ন ঘটেছে। বিদ্যুতের ঝলমলে আলোর ব্যবহার আগের হ্যাজাক বাতির জায়গা নিয়েছে।
বর্ণাঢ্য মেলা ও মিলনমেলা
উৎসব উপলক্ষে মাধবপুর ও আদমপুরে বসে বিশাল মেলা। দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করতে সমবেত হন।
সংস্কৃতির সংযোগ ও ঐতিহ্যের রক্ষা
মণিপুরি সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলেন, মহারাসলীলা তাদের জন্য শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীর প্রতিফলন। শিশু থেকে বয়স্ক—সবার জন্য এই উৎসব এক মিলনমঞ্চ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, “শত বছরের এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবে প্রায় তিন লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করেছে।”
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্যের সংরক্ষণ
এই উৎসব কেবল অতীতের ঐতিহ্যের ধারকই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মশাল পৌঁছে দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। দুই স্থানেই মহারাস উৎসবের আয়োজন কমিটিগুলো এ ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে শুরু হয়ে ভোরের সূর্যের কিরণে শেষ হওয়া মহারাসলীলার এ উৎসব মানুষের মনে এক অনন্য অনুভূতি এনে দিয়েছে।
তারিখ: ১৬.১১.২০২৪