বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষার দাবিতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণসমাবেশ

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষার দাবিতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণসমাবেশ

ঢাকা, ৪ঠা অক্টোবর: বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চলমান নির্যাতন ও সহিংসতার প্রতিবাদে ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার হাজার সংখ্যালঘু সদস্যের অংশগ্রহণে এক বিশাল গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সমাবেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সনাতনী হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণ উপস্থিত ছিলেন। তারা সরকারের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ৮ দফা দাবির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান। বক্তারা বলেন, গত দুই মাস ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর, হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে, যা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষার দাবিতে শুক্রবার, ৪ঠা অক্টোবর, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক বিশাল গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ সংখ্যালঘু ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এই সমাবেশে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা হাজার হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দেন।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। দুই মাস আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন এবং তিনি ভারত চলে যান। এর পরপরই শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পরপরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নানা ধরনের সহিংসতা শুরু হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করেছে, এই সহিংসতাগুলো ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এটিকে নিছক রাজনৈতিক সংঘাত হিসেবে মানতে নারাজ এবং তারা বলছে যে, এ ধরনের হামলা তাদের ধর্মীয় ও জাতিগত সত্ত্বাকে লক্ষ্য করে ঘটানো হয়েছে।

৮ দফা দাবি

সমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা ৮ দফা দাবি পেশ করেন, যা হলো:

১. সংখ্যালঘু নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা: সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

২. সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: সংখ্যালঘু সুরক্ষার জন্য একটি পৃথক আইন প্রণয়ন করে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, অধিকার ও সম্পত্তি সুরক্ষিত করতে হবে।

৩. সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যা ও তাদের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি “সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়” গঠন করতে হবে।

৪. হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের উন্নয়ন ও সংখ্যালঘু ফাউন্ডেশন গঠন: হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে “হিন্দু ফাউন্ডেশন”-এ উন্নীত করতে হবে এবং একইসঙ্গে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান কল্যাণ ট্রাস্টগুলোকেও ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করতে হবে।

৫. দখলকৃত দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন: দখলকৃত দেবোত্তর সম্পত্তি ও সংখ্যালঘুদের জমি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষার জন্য একটি কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে হবে।

৬. বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে উপাসনালয় নির্মাণ: দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ করতে হবে এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনার ঘর বরাদ্দ দিতে হবে।

৭. শারদীয় দুর্গাপূজার জন্য ৫ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা: দুর্গাপূজার জন্য ৫ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করতে হবে এবং প্রতিটি সংখ্যালঘু ধর্মীয় উৎসবের জন্য প্রয়োজনীয় ছুটি নিশ্চিত করতে হবে।

৮. সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের আধুনিকায়ন: সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডকে আধুনিকায়ন করতে হবে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।

বক্তাদের বক্তব্য

সমাবেশে বক্তারা বলেন, “প্রতিদিন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, নির্যাতন এবং বৈষম্যের ঘটনা ঘটছে। আমরা সরকারের কাছে আমাদের অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা সুরক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই।” তারা আরও বলেন, “সরকার যদি দ্রুত আমাদের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে আমাদের আন্দোলন আরও তীব্র ও ব্যাপক হবে। আমরা আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার সুরক্ষিত করতে মাঠে থাকব।”

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান

সমাবেশে বক্তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানান। তারা বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও সম্পত্তি দখলের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে অবহিত করতে হবে। আমরা চাই, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করুক।”

প্রশাসনের কাছে আহ্বান

গণসমাবেশে উপস্থিত সংখ্যালঘু নেতারা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “সরকারকে অবিলম্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমরা চাই, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষের জানমাল ও সম্পত্তি সুরক্ষিত থাকুক এবং এ দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন সমান সুযোগ ও মর্যাদা ভোগ করতে পারে।”

সমাবেশের প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া

সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হলেও উপস্থিত অনেকেই প্রশাসনের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই বিষয়ে উদাসীনতা পরিহার করতে হবে।”

ভবিষ্যতের কর্মসূচি

বক্তারা আরও জানান, “এই ৮ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না। প্রয়োজনে আমরা আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিকভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চালিয়ে যাব।”

গণসমাবেশে উপস্থিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, সরকারের সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়িত হবে এবং দেশে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরে আসবে।

তারিখ ০৪.১০.২০২৪