এই ব্লগের এই অংশে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা, মানবাধিকার, আইনগত
সহায়তা ও ন্যায়বিচার সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করা হয়। নির্যাতন, বৈষম্য,
জরুরি সহায়তা, কমিউনিটির সুরক্ষা, অধিকার সচেতনতা ও জনমত গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়ে এখানে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ, অভিজ্ঞতা এবং ঘটনা তুলে ধরা হয়। এটি আমাদের
কমিউনিটির ন্যায়বিচারের সংগ্রামকে নথিভুক্ত ও শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ
প্ল্যাটফর্ম।
নির্যাতন, আইনি সহায়তা, কমিউনিটি সুরক্ষা, জরুরি প্রতিক্রিয়া, দুর্বল জনগোষ্ঠীর
সংরক্ষণ, অন্যায়ের দলিলীকরণ, অ্যাডভোকেসি এবং জনসচেতনতা কার্যক্রমসহ সকল বিষয় এ
ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত।
উপবিষয়সমূহ:
মানবাধিকার লঙ্ঘন
আইনি সহায়তা ও মামলার ফলো-আপ
উদ্ধার ও জরুরি সহায়তা
নিরাপত্তা সতর্কতা ও কমিউনিটি সুরক্ষা
অ্যাডভোকেসি ও গণমাধ্যম বিবৃতি
নারী, শিশু ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর সহায়তা
বাংলাদেশ গণহত্যা - ড. মাস্সিমো ইনত্রোভিনিয়ে
ধর্মসমাজবিদ হিসেবে বিশ্বের নানা প্রান্তে নিপীড়ন, পরিচয়বোধ ও সংখ্যালঘু ঝুঁকির
প্রকৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করার অভিজ্ঞতা থেকে ড. মাস্সিমো ইনত্রোভিনিয়ে
দেখেছেন—অনেক ট্র্যাজেডি বিশ্বস্মৃতি থেকে মুছে যায় গুরুত্বহীনতার কারণে নয়, বরং
বিশ্ববাসী প্রায়ই সেই সত্যকে সম্পূর্ণভাবে মুখোমুখি হতে দ্বিধা করে। বাংলাদেশের
গণহত্যা—বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর সংগঠিত লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতা—আধুনিক ইতিহাসের
এমনই এক অবমূল্যায়িত অধ্যায়।
এই আট-পর্বের সিরিজ সেই সময়কার ঘটনাগুলোকে তুলে ধরতে চায় স্পষ্টতা, ভারসাম্য এবং
গবেষণাভিত্তিক দায়িত্ববোধ নিয়ে। এখানে শুধু নৃশংসতার ঐতিহাসিক তথ্যই নয়, বরং যে
সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো এ ঘটনাকে রূপ দিয়েছে, সেগুলোরও বিশ্লেষণ
রয়েছে। একই সঙ্গে এটি বেঁচে থাকা মানুষদের কণ্ঠ তুলে ধরে, প্রান্তিক সম্প্রদায়ের
যন্ত্রণা স্বীকার করে এবং দেখায় কীভাবে ঘৃণা ও বৈষম্যের ধারা ধীরে ধীরে সংগঠিত
সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।
ড. ইনত্রোভিনিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন যে এই কাজ বিশ্বব্যাপী বোঝাপড়া বাড়াতে
সহায়তা করবে—কীভাবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা সহজেই লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে, কেন
প্রাথমিক সতর্কসংকেতগুলো প্রায়ই অদৃশ্য থেকে যায়, এবং স্মরণচর্চা ভবিষ্যতের
অন্যায় থামাতে কতটা জরুরি। তাঁর কাছে এই ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা কেবল একাডেমিক দায়
নয়—এটি একটি নৈতিক কর্তব্য।
বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ১ – “পূর্ব পাকিস্তান” এর সন্ধানে
১৯৪৭ সালে দুইটি অসংলগ্ন অংশ নিয়ে পাকিস্তানের অদ্ভুত রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে গণহত্যার ভিত্তি তৈরি হয়।
by Massimo Introvigne
পর্ব 1/8
২০২১ সাল ছিল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যার ৫০ বছর পূর্তি—যা ২০শ শতকের সবচেয়ে
নৃশংস অথচ সবচেয়ে উপেক্ষিত অধ্যায়গুলোর একটি। বিশেষ করে ২০২১ সালের অক্টোবরে
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নতুন করে হামলা শুরু হওয়ায় এ দিবসটি আরও বেদনাদায়ক ও
অশুভ হয়ে ওঠে।
গণহত্যা ঘটেছিল ১৯৭১ সালে, কিন্তু এর শিকড় অনেক পুরোনো। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো
হল মুসলিম ঐতিহ্যবাদী ও মৌলবাদীদের অভিযোগ যে অধিকাংশ বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান নাকি
“গোপন হিন্দু।” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো—যারা নিপীড়ন এড়াতে নিজেদের মুসলমান (বা
খ্রিস্টান) বলে পরিচয় দেয়—কিন্তু পরে এটি হয়ে ওঠে সুফি ও লোকধারার অনুসারীদের
বিরুদ্ধে অপমানসূচক শব্দ, কারণ তাদের কিছু আচরণ মৌলবাদীদের চোখে “অর্থডক্স”
অনুযায়ী ছিল না। তারা মাঝে মাঝে হিন্দু বা শিখ ধর্মস্থলেও যেতেন।
বর্তমান বাংলাদেশের অঞ্চলে এই ধরনের ইসলাম ছিল প্রচলিত, যদিও তৎকালীন জামায়াতে
ইসলামীও সক্রিয় ছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দেয় (যদিও প্রথমে
ডমিনিয়ন রূপে)। তাঁদের ধারণা ছিল—হিন্দু-মুসলিম বিরোধ বাড়তে থাকলে একক ভারত রাখা
গেলে গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যা হবে। সমাধান হিসেবে তাঁরা করলেন দেশভাগ—হিন্দুদের জন্য
ভারত এবং মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ জায়গায় থাকার কথা থাকলেও ১ থেকে ২ কোটি মানুষ দেশভাগে
চলে আসেন—কারণ তাঁরা এমন দেশে থাকতে চাননি যেখানে তাঁদের ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
তবুও অনেকেই থেকে যান। আজও ভারতে ২০ কোটির বেশি মুসলমান, পাকিস্তানে কমপক্ষে ৪
মিলিয়ন হিন্দু (হিন্দুরা দাবি করেন প্রকৃত সংখ্যা ৮ মিলিয়নের কাছাকাছি), এবং
বাংলাদেশে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি হিন্দু বসবাস করেন।
পাকিস্তান গঠিত হয় এক অদ্ভুত রাষ্ট্র হিসেবে—একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান
পাকিস্তান) এবং অন্যদিকে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)—একই
সরকারের অধীনে, কিন্তু দুটির মাঝে ছিল ১৭০০ কিলোমিটার দূরত্ব ও মাঝখানে ছিল ভারত।
এর সীমানা তৈরিতে রেফারেন্স নেওয়া হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে—যা ১৯১১ সালে
বাতিল হলেও ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার ভিত্তি নির্ধারণে কাজে লাগে।
দেশভাগে দুটি বড় সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, এটি ব্রিটিশদের আশা মতো
শান্তিপূর্ণভাবে ঘটেনি। কোটি কোটি মানুষের পুনর্বাসন সৃষ্টি করে উত্তেজনা, লুট,
হত্যাকাণ্ড। অনেকেই থাকতে চাইলেও ভিন্ন ধর্মের দাঙ্গাবাজদের হাতে আক্রান্ত হন,
পালাতে বাধ্য হন বা নিহত হন। বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও ধারণা করা হয়—দেশভাগে প্রায় ১০
লাখ মানুষ মারা যায়।
পূর্ব বাংলাতেও সহিংসতা ছড়ায়, যেখানে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর ওপর হামলা চালায় মুসলিম
দাঙ্গাবাজরা। ব্রিটিশদের সীমারেখা তৈরি ছিল অগোছালো। ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু অধ্যুষিত
খুলনা জেলা পাকিস্তানের অংশ হয়, আর কিছু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা যায় ভারতের
অন্তর্ভুক্ত।
ভৌগোলিক কারণে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলও পূর্ব বাংলার হাতে আসে—যেখানে বৌদ্ধ ছিল
সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং হিন্দুরাও ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার দিনে
সেখানকার বৌদ্ধ ও হিন্দুরা ভারতীয় পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন—তাঁরা ভাবতেন
তাঁরা ভারতের অংশ। দুই দিন পর তাঁদের জানানো হয়—তারা পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেছেন।
বিদ্রোহের চেষ্টা হলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অঞ্চলটি দখল করে এবং ঘটে হত্যাকাণ্ড,
ধর্ষণ, নির্যাতন।
দ্বিতীয় সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে
অনেক গরিব ছিল। পশ্চিমারা তাদেরকে “পিছিয়ে পড়া” এবং পুরোনো অভিযোগ অনুসারে
“খারাপ” মুসলমান মনে করত। আবার জনসংখ্যাগত ভারসাম্যও দ্রুত বদলে যায়। ১৯৪৭ সালে
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান উভয়ের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি। কিন্তু পূর্ব
পাকিস্তানে বেড়ে যায় অভিবাসন এবং জন্মহার বৃদ্ধির ফলে। ১৯৭১ সালে বিহারি
মুসলমানরা হবে গণহত্যার উভয়ই— অভিনেতা এবং শিকার। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের
জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটি ২০ লাখ, আর পশ্চিম পাকিস্তানের ৩ কোটি ৩৭ লাখ।
রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র ও সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে ছিল।
কিছু বাঙালি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হলেও তাদের সময়কাল ছিল স্বল্প এবং
প্রায়ই তাঁদের উৎখাত করা হয় সামরিক অভ্যুত্থানে। সামরিক বাহিনীর উচ্চপদে
পূর্বাঞ্চলীরা ছিল গণনাযোগ্য সংখ্যালঘু।
এতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ
গণতান্ত্রিক সরকার চাইতেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভোট হলে পূর্ব পাকিস্তানের আসন বেশি,
এবং সেখানে আওয়ামী লীগ ছিল প্রধান শক্তি। সুতরাং যেকোনো প্রকৃত নির্বাচন আওয়ামী
লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেবে—ফলে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানকে শাসন করবে দরিদ্র পূর্ব
পাকিস্তান। এই কারণে দেশটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন এড়িয়ে চলে—অবশেষে ১৯৭০ সালে
নির্বাচন হয়, এবং তার ফলেই শুরু হয় গণহত্যার দিকে অগ্রযাত্রা।
বাংলাদেশ গণহত্যা. পর্ব ২ - ভাষা আন্দোলন
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাইছিলেন বাংলা যেন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষাগুলির একটি হয়। রক্তাক্ত দমন-পীড়নের পর, ১৯৫৬ সালে তারা এই দাবিতে জয় পান।
by Massimo Introvigne
পর্ব 2/8
১৯৪৮ সালের মার্চে, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, আধুনিক পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬–১৯৪৮) পূর্ব বাংলায় আসেন। তিনি ঘোষণা করেন—উর্দুই হবে
পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল সাংস্কৃতিক যুক্তি। কারণ,
মুঘল আমল থেকে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে উর্দু ছিল ঐক্যের প্রতীক।
তবে বাংলার মুসলমানরা ছিলেন ব্যতিক্রম। বাংলার ছিল সমৃদ্ধ সাহিত্য ও ধর্মীয়
ঐতিহ্য। তাই তারা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করতে চাননি। ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের
রাজনৈতিক উত্থানের সময় থেকেই বাঙালিরা দাবি করতেন—উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও মুসলিম
সংগঠনগুলোর সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ১৯শ শতকের ‘বাঙালি রেনেসাঁ’
বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়—হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের মধ্যেই। ১৯৪৭
সালে পাকিস্তানের ৫৪% নাগরিকের ভাষাও ছিল বাংলা।
তারপরও জিন্নাহ উর্দুকেই বেছে নিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে এটি দেখা হয়েছিল পশ্চিমের
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল হিসেবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সফরেই
জানালেন—উর্দু ছাড়া আর কোনও ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না। ভিন্নমতের মানুষকে তিনি ভারত
ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দোসর বলেও আক্রমণ করলেন।
জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসার সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইতিমধ্যেই উর্দু
আরোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছিল। জিন্নাহ ২১
মার্চ ঘোষণা দেন এবং ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বক্তব্য রাখেন। ছাত্ররা বারবার
বাধা দেওয়ায় তিনি কষ্টে বক্তব্য শেষ করেন।
পরের কয়েক মাসে জিন্নাহর যক্ষ্মা ধরা পড়ে এবং পরে ফুসফুসের ক্যান্সারও শনাক্ত হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। ভাষা-দাবি ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী মুসলিম
লীগের (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়।
পূর্বের মানুষ আশা করেছিল নতুন নেতৃত্ব ভাষা প্রশ্নে নমনীয় হবে। কিন্তু ১৯৫২ সালের
জানুয়ারিতে পাকিস্তানের গণপরিষদ আবারও জানাল—রাষ্ট্রভাষা শুধু উর্দুই। আওয়ামী
লীগের নেতৃত্বে ঢাকা জ্বলে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে পাঁচ ছাত্র (সম্ভবত
আরও বেশি) শহীদ হন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে
জাতিসংঘ ঘোষণা করে।
২২ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলন সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। আরও মানুষ নিহত হন।
সরকার আবারও ভারতের ও সোভিয়েতের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তুলে ধরল। ২৩ ফেব্রুয়ারি
শহীদদের স্মরণে ঢাকায় একটি সাময়িক স্মৃতিস্তম্ভ গড়া হয়, যা ২৬ ফেব্রুয়ারি
পুলিশ ভেঙে ফেলে। হাজারো মানুষ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ, গ্রেফতার হন।
এক বছর পর, ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় লাখো মানুষের সমাবেশ হয়। শহীদ মিনারের
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতেও স্মরণানুষ্ঠান চলতে থাকে।
ধীরে ধীরে বাঙালিরা জয় অর্জন করে। ১৯৫৪ সালের মধ্যে গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য
বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দাঁড়ান। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এটি
বাস্তবায়িত হয়। মিলনের বার্তা দিতে সরকার শহীদ মিনার নির্মাণেও সহায়তা করে।
তবে এই পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা বেশিদিন টেকেনি। ভাষা-আন্দোলনের সাফল্যের পর বাঙালি
জাতীয়তাবাদীরা বিভক্ত হন—কেউ পাকিস্তান থেকে আলাদা স্বাধীনতা চান, কেউ চান
স্বায়ত্তশাসন ও শক্তিশালী ফেডারেল কাঠামো।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের (১৯০৭–১৯৭৪) সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান বাতিল
হয়। সেনাবাহিনীর কিছু অংশ আবারও উর্দু-একভাষার পক্ষে মত দেয়। তারা শেষ পর্যন্ত
ব্যর্থ হয়। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে রয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ায়
আওয়ামী লীগ নেতারা আবারও কারাবন্দি হন।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধ শুরু হয় কাশ্মীর নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তান
অভিযোগ করল—তাদের সম্পদ পশ্চিমের যুদ্ধেই শেষ হয়েছে, সীমান্ত রক্ষাই হয়নি, আর
ক্ষমতা থেকেও তারা বঞ্চিতই রয়ে গেছে।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফা দাবি’ ঘোষণা করে। এতে বলা হয়—পাকিস্তান হবে একটি
ফেডারেল রাষ্ট্র। কেন্দ্র শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দেখবে। অন্য সব ক্ষমতা
রাজ্যগুলোর হাতে থাকবে। এটি বিচ্ছিন্নতার দাবি ছিল না। তবুও আইয়ুব খান এবং নতুন
সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান (১৯১৭–১৯৮০) আওয়ামী লীগকে “বিচ্ছিন্নতাবাদী” বলে
আক্রমণ করেন। ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করেন—প্রয়োজনে তিনি
গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। শেষ পর্যন্ত সেই হুমকি সত্যিই বাস্তবতা হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ গণহত্যা. পর্ব ৩ - বাঙালি নেতাদের দমন অভিযান
১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯—এই সময়ে আইয়ুব খানের শাসন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তারা ব্যর্থ হয়, কিন্তু পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়।
by Massimo Introvigne
পর্ব 3/8
আগের লেখাগুলোতে আমরা দেখেছি—পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে সংকট
ছিল অমীমাংসিত। অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ভাঙলে পশ্চিমেও অস্থিরতা তৈরি হতো। কিন্তু
নির্বাচন সত্যি হলে জনসংখ্যার কারণে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পুরো দেশ শাসন
করতে পারত, যা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা একচেটিয়াভাবেই শেষ করে দিত।
সমস্যা আরও জটিল ছিল কারণ পশ্চিমে বহু সংগঠিত রাজনৈতিক দল থাকলেও পূর্বে কার্যত একটিই
প্রভাবশালী দল—আওয়ামী লীগ। ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা মুসলিম লীগের
বিরোধ করে দলটি গঠন করেন। মুসলিম লীগ তখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে ছিল।
দলের তিনজন যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০–১৯৭৫), সবার পরিচিত
‘মুজিব’, দ্রুতই প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের জনক হন।
১৯৭৫ সালে তাকে হত্যা করা হয়। তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা বর্তমান বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী।
মুজিব ভাষা আন্দোলনেরও অন্যতম মুখ ছিলেন। ১৯৪৮ সালে এই কারণে তাকে তিনবার গ্রেফতার করা
হয়। ১৯৫০–৫২ সালে আবার দুই বছর কারাবন্দি থাকেন, বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে। ১৯৫২ সালের
ভাষা আন্দোলনের পর মিলনচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি পূর্ব বাংলা সরকার এবং পাকিস্তানের
গণপরিষদ—উভয়ের সদস্য হন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন এলে মুজিব আবারও গ্রেফতার হন—১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে
মুক্তি পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করেন। এটি ছিল
ফেডারেল পাকিস্তানের মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের দাবি—যার কথা আগের লেখায়
উল্লেখ করা হয়েছে।
ছয় দফা বাঙালিদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের চোখে এটি ছিল
গোপন বিচ্ছিন্নতার রূপরেখা। জাতীয় নির্বাচনের দাবি বাড়তে থাকলে আইয়ুব সরকার ঠিক করল—
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের আগেই দুর্বল করতে হবে। মুজিবকে সরাতে হবে।
তারা ব্যবহার করল গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাকে। ডিসেম্বর ১৯৬৭ সালে আইয়ুব
খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। গণমাধ্যম মতে সফর স্বাভাবিক ছিল। তবে দেশে ফিরেই
গোয়েন্দারা দাবি করল—বাঙালি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। প্রমাণ
অপ্রতুল হলেও ৬০ জন নেতা ও সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে মার্কিন তদন্তে
প্রকাশ পায়—এমন কোনো হত্যাচেষ্টা ছিল না।
তবুও পাকিস্তানের আইএসআই দাবি চালিয়ে যায়—ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র বিদ্রোহের অংশ
হিসেবে আইয়ুবকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এটিকে বলা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’—
অভিযোগ ছিল, বাঙালি নেতারা ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে
গোপন বৈঠক করেছে। ১,৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মুজিবও ছিলেন তাদের মধ্যে। তবে আদালতে
তোলা হয় মাত্র ৩৫ জনকে। উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ ও মুজিবকে ধ্বংস করা। একই সময়ে
পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো (১৯২৮–১৯৭৯) নতুন দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি
গঠন করেছেন, ফলে নির্বাচন অনিবার্য হয়ে উঠছিল।
পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে। আওয়ামী লীগের কেউ ভারতের সঙ্গে কথা বলেছিল—এটা
অসম্ভব ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ বা সহিংসতার কোনো দৃঢ় প্রমাণ ছিল না।
এদিকে চলছিল আগরতলা মামলা। শুরু হয়েছিল ১৯ জুন ১৯৬৮। মামলা চলাকালে ১৫ ফেব্রুয়ারি
১৯৬৯—বন্দী আসামি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক (১৯৩৫–১৯৬৯) এক প্রহরীর
গুলিতে নিহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবারও প্রথমে প্রতিবাদে নামে। পরে
লাখো বাঙালি রাস্তায় নামে। রাজশাহীতে প্রতিবাদে যোগ দেওয়া শিক্ষক মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা
(১৯৩৪–১৯৬৯) পুলিশ গুলিতে নিহত হন।
অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার জানায়—আগরতলা মামলা প্রত্যাহার
করা হচ্ছে। সকল আসামি মুক্তি পান। ঢাকায় লাখো মানুষ মুজিবকে অভ্যর্থনা জানান। তাকে দেওয়া
হয় খেতাব—“বঙ্গবন্ধু”—অর্থাৎ “বঙ্গের বন্ধু”।
আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের পরিকল্পনা উল্টো আইয়ুব সরকারের জন্য বিপর্যয় হয়ে দাঁড়ায়।
দলটি ধ্বংস না হয়ে বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
কিন্তু আইয়ুব খানকে গোয়েন্দারা ভুল তথ্য দেয়। বলা হয়—আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে গেছে,
নির্বাচনে জিতবে না। তাই তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন
ঘোষণা করেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল—হার্ট অ্যাটাক ও পক্ষাঘাতে তিনি হুইলচেয়ারে
চলে গিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানকে
(১৯১৭–১৯৮০), যিনি সম্ভবত আগে থেকেই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন।
তবুও নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। একে আর থামানোর কোনো উপায় ছিল না।
বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৪ - ১৯৭০, সিদ্ধান্তের বছর
প্রাকৃতিক দুর্যোগে নির্বাচন স্থগিত হয়। পরে নির্বাচন হলে পাকিস্তানে দেখা দেয় এক অমীমাংসিত রাজনৈতিক সংকট।
by Massimo Introvigne
পর্ব ৪ / ৮
আগের অংশে আমরা দেখেছি পাকিস্তান সরকারের নানা কৌশল। পশ্চিম পাকিস্তান-শাসিত সরকার
চেয়েছিল আওয়ামী লীগকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঠেকাতে। জনসংখ্যা-পরিসংখ্যান তাদের
পক্ষে ছিল না, কারণ পূর্ব পাকিস্তানে ভোটারের সংখ্যা ছিল বেশি।
আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আবার পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী
ভুট্টোর (১৯২৮–১৯৭৯) সমাজতান্ত্রিক পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতৃত্বে নির্বাচনের
দাবি জোরালো হয়। সামরিক শাসন থাকলেও নির্বাচন বাতিল করা তখন আর মুশকিল ছিল।
এরপর প্রকৃতি আঘাত হানে। ১৯৭০ সাল পাকিস্তানের জন্য ভয়াবহ বছর। শুরুতেই বন্যায়
হাজারো প্রাণহানি। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান (১৯১৭–১৯৮০) ১৫ আগস্ট ঘোষণা
করেন যে ৫ অক্টোবরের নির্বাচন পিছিয়ে ৭ ডিসেম্বর করা হবে।
অনেকে মনে করতেন এটি সময় কেনার চেষ্টা। ইয়াহিয়া পুরো নির্বাচনই বাতিলের পথ
খুঁজছিলেন। তবে দুর্যোগ বাস্তব ছিল। অক্টোবরের দুই ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানে
১৬,০০০ মানুষ মারা যায়। এরপর ১২ নভেম্বর ১৯৭০-এর ভোলা সাইক্লোন। এটি ইতিহাসের
সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। আধুনিক যুগের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর একটি।
পূর্ব পাকিস্তানে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। পুরো গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়। লাখো
মানুষ ঘর-বাড়ি ও জীবিকা হারায়।
আগের বিতর্কের কারণে নির্বাচন আর পিছানো গেল না। বরং ভোলা সাইক্লোনই নির্বাচনের মূল
আলোচ্য হয়ে ওঠে। ত্রাণ ছিল ধীর ও অপর্যাপ্ত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাস
করল—এও সেই পুরনো অবহেলা। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক
নয়।
৭ ডিসেম্বর ১৯৭০-এ সাধারণ নির্বাচন হয়। উপকূলের নয়টি জেলায়, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত
অবস্থার কারণে ভোট হয় ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১-এ। ধ্বংসযজ্ঞের পরও ভোট উপস্থিতি ছিল ৬৩%।
প্রত্যাশিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে ভোট বেশি পড়ে। ইতিহাসবিদদের মতে পাকিস্তানের
সবচেয়ে সুষ্ঠু এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জয়ী হয়। তারা ১৬৭টি আসন পায়—পূর্ব
পাকিস্তানের প্রায় সব আসন, মাত্র দুইটি বাদে। ৩১৩ আসনের জাতীয় পরিষদে এটি ছিল
পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি দ্বিতীয় স্থানে, মোট ৮৬
আসন। জামাত-ই-ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোও কিছু আসন পায়।
সকল ভ্রম ভেঙে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন সত্যি
হলো। জাতীয় পরিষদ বসলেই আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করবে। তখন তারা শুধু পূর্ব
পাকিস্তান নয়, পশ্চিম পাকিস্তানও শাসন করবে। আগের অংশে যেমন উল্লেখ করেছি—এটি
বেশির ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানির কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খান
অন্যান্য বিষয়ে মতভেদ থাকলেও একটি বিষয়ে এক—আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে তারা বাধা
দেবে। আওয়ামী প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০–১৯৭৫) বা মুজিব যেন প্রধানমন্ত্রী না
হন।
১৫ জানুয়ারি ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে। তিনি প্রস্তাব
দেন—জাতীয় পরিষদ বসবে ৩ মার্চ। মুজিব প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, কিন্তু ইয়াহিয়া
রাষ্ট্রপতি থাকবেন পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কিন্তু ভুট্টো এতে রাজি
নন। তিনি ১৯৭০-এর লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (LFO) ব্যাখ্যা করে বলেন—শুধু পূর্ব
পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে না। তাই তিনিই
প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত।
মুজিব-ভুট্টো বৈঠকে কোনো সমাধান হয় না। ইয়াহিয়া পরিষদের প্রথম অধিবেশন পিছিয়ে
দেন, যতক্ষণ না উভয়পক্ষ তারিখে একমত হন।
এদিকে আরেক জটিলতা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব জনপ্রিয় হলেও সবাই তার পক্ষে
ছিল না। ইসলামি মৌলবাদীরা, বিশেষ করে জামাত-ই-ইসলামির সদস্যরা, ধর্মকে ভাষা বা
জাতিগত পরিচয়ের থেকেও বড় মনে করতেন। তারা মুজিবকে “ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান” হিসেবে
দেখে বিরোধিতা করতেন। পাশাপাশি কিছু ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘুও ছিল, যারা
নিজেদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছাকাছি ভাবত।
তাদের মধ্যে ছিল ৫–১০ লাখ বিহারি মুসলমান। ভারতের বিহার থেকে ১৯৪৭-এর দেশভাগে তারা
পূর্ব পাকিস্তানে আসে। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতাও
করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এলে বঞ্চনার আশঙ্কায় মার্চের প্রথম সপ্তাহে তারা
রাস্তায় নামে। তারা দাবি করতে থাকে—আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের সুযোগ
দেওয়া যাবে না। এতে বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। প্রায় ৩০০ বিহারি নিহত হয়।
৭ মার্চ মুজিব ঘোষণা করেন—এটি এখন “স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তবুও তিনি ইয়াহিয়া ও
ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা রাখেন। ১৫ ও ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া আবার ঢাকায় এসে
মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু মুজিবকে তিনি বলেননি—পশ্চিম পাকিস্তান অধ্যুষিত
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই এক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পশ্চিম
পাকিস্তান থেকে সৈন্য এসে পূর্ব পাকিস্তান দখল করবে, সামরিক শাসন দেবে, এবং আওয়ামী
নেতাদের গ্রেপ্তার করবে। তখন কেউ জানত না—ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের মাত্র দশ দিন পরই
শুরু হবে গণহত্যা।
বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৫ - প্রথম হত্যাক্ষেত্র
২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুরু করে “অপারেশন সার্চলাইট।” Blitzkrieg হওয়ার কথা ছিল। পরিণত হয় গণহত্যায়।
by Massimo Introvigne
পর্ব ৫ / ৮
আগের অংশগুলোতে আমরা দেখেছি—৭ ডিসেম্বর ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস
জয়ই ছিল গণহত্যার মূল কারণ। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে নির্বাচিত এই দল জাতীয়
পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব
পাকিস্তানিদের অধীনে চলতে রাজি ছিল না। সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান
(১৯১৭–১৯৮০) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম দল পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী
ভুট্টো (১৯২৮–১৯৭৯)—দুজনেই সমাধান খুঁজতে আওয়ামী প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের
(১৯২০–১৯৭৫) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।
মুজিব আলোচনা চালালেও ২৩ মার্চ ১৯৭১ তিনি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে উত্তেজিত
জনতার সামনে বক্তব্য দেন—তারপরই ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেষ বৈঠকে যান।
তবে আলোচনার আড়ালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফেব্রুয়ারিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—পূর্ব
পাকিস্তানকে সামরিক দখলে নেবে। মার্চের শুরুতে বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায় ৩০০
বিহারি নিহত হয়। সেনাবাহিনী পরে এসব ঘটনা হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে দেখালেও এখন
জানা যায়—বিহারি দাঙ্গার আগেই সামরিক অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের নথিগুলোর বেশিরভাগই পাকিস্তানে গোপন। তবে ২০০০ সালে কিছু নথি প্রকাশিত
হয়, যার মধ্যে ছিল হামুদুর রহমান কমিশনের আংশিক রিপোর্ট। কমিশনটি ১৯৭১ সালের
ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকারই গঠন করেছিল। রিপোর্টটি আন্তর্জাতিকভাবে উপহাসের পাত্র
হয়—কারণ তারা দাবি করেছিল বাঙালি নিহত মাত্র ২৮,০০০। এই সংখ্যার দশ গুণ বাড়ালেও
কম হতো। তবে নথিগুলো দেখায় সেনাবাহিনী শুরুতে কী ভাবছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল—মাত্র ৩০,০০০ সেনা দিয়ে দুই সপ্তাহে পূর্ব
পাকিস্তানকে “শান্ত” করা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও তাদের সমর্থনকারী
বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করা হবে। আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে
পুরোপুরি সামরিক নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। পূর্ব পাকিস্তান বংশোদ্ভূত সেনাদের
নিরস্ত্র করা হবে, কারণ তাদের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ ছিল। সব গণমাধ্যম বন্ধ করে পুরো
অঞ্চলকে অস্থায়ী সামরিক প্রশাসনের অধীনে রাখা হবে।
“অপারেশন সার্চলাইট” নামে এই পরিকল্পনা শুরু হয় ২৫ মার্চ ১৯৭১, বিদেশি সাংবাদিকদের
দেশছাড়া করার পর। ১০ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। প্রথম দিনই
মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। আন্তর্জাতিক চাপে তার
প্রাণসংহার ঠেকে যদিও, বছরজুড়ে তিনি কারাগারেই ছিলেন। তবে মুজিবের গ্রেপ্তার
আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের সতর্ক করে দেয়। অনেকেই ভারতে পালিয়ে যান, কেউ কেউ
আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ব পাকিস্তানের সেনারা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি
প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের এক বাঙালি-নিয়ন্ত্রিত রেডিও থেকে
আওয়ামী লীগের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়—বন্দী মুজিবের নামেই। এতে
বাঙালির মনোবল আরও দৃঢ় হয়। সেদিনই সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে, তবে
ততক্ষণে প্রায় ৪০০ ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে। শত শত ছাত্রী ধর্ষণের শিকার
হন।
পূর্ব পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্রীকরণে বাধা দেয়। হাজারো সেনা নিহত হয় অভিযানের
প্রথম কয়েক দিনে। ১০ এপ্রিল নাগাদ সেনাবাহিনী ঢাকা ও বড় শহরগুলো দখলে নিলেও
চট্টগ্রামে প্রতিরোধ ছিল। রাজশাহী, সিলেটসহ মাঝারি শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিরাট অংশ
তখনো আওয়ামীপন্থী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
অভিযান শেষ হওয়ার বদলে ১০ এপ্রিল ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা
হয়। মুক্তিবাহিনীও আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়।许运 িকভাবে সরকার গঠিত হয়
আগরতলায়—যে শহরকে পাকিস্তান সরকার একসময় “ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র” বলেছিল। ১৭ এপ্রিল
পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে, বৈদ্যনাথতলায় (স্বাধীনতার পর নাম হয় মুজিবনগর) শপথ
হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও আক্রমণাত্মক। সেনা বাড়িয়ে সংখ্যা প্রায়
এক লাখে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেক বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—আওয়ামী বিরোধী
পূর্ব পাকিস্তানি গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র দেওয়া। এরা ছিল বিহারি মুসলমান এবং ইসলামি
মৌলবাদী দলগুলো, বিশেষ করে জামাত-ই-ইসলামির সদস্যরা। পরবর্তী মাসগুলোতে এই
মিলিশিয়ারা সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার অংশ হয়। স্বাধীনতার পর প্রতিশোধে হাজারো
বিহারি ও জামাত সদস্য নিহত হয় বাংলাদেশিদের হাতে।
এই মিলিশিয়াদের ব্যবহারই ছিল নতুন পরিকল্পনার অংশ—পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার বড়
অংশকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এক নির্মূল যুদ্ধ। এই গণহত্যা কীভাবে চলেছিল, তা আমরা
পরবর্তী অংশে আলোচনা করব।
বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৬ - নির্মম হত্যাযজ্ঞ
কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় তিন মিলিয়ন বাঙালি নিহত হন। হ্যাঁ, এটি ছিল একটি গণহত্যা।
by Massimo Introvigne
পর্ব ৬/ ৮
পূর্বের লেখাগুলোতে দেখেছি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে বাধা দিতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মার্চ ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। এরপর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে—বাংলাদেশ নামে।
প্রতিরোধ শক্তিশালী হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান আরও সৈন্য পাঠায় এবং স্থানীয় সহযোগী মিলিশিয়া গঠন করে। ঘটনার পঞ্চাশ বছর পর পাওয়া দলিলগুলো দেখায়—এপ্রিলের পর পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঠিক করেছিল, পূর্ব পাকিস্তানের সমাজের কিছু অংশকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে হবে। লক্ষ্য ছিল—পূর্ব বাংলা থেকে আসা সেনা ও পুলিশ যারা সহযোগিতা করেনি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী, এবং হিন্দু পুরুষরা। হিন্দু নারীরা ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তির জোর, বা জোরপূর্বক বিয়ের শিকার হন।
হিন্দুদের প্রসঙ্গে পরের লেখায় ফিরব। খ্রিস্টানদেরও আক্রমণ করা হয়েছিল। যেমন, রাঙামাটিয়া গ্রামে—যেখানে বেশিরভাগই ক্যাথলিক—৯০% ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ১৪ জন নিহত হন। চার্চ লুট করা হয়; পূর্ব পাকিস্তানের আরও ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
অন্য সমস্ত শ্রেণীই ছিলেন মুসলিম। অর্থাৎ, ১৯৭১-এর হত্যাযজ্ঞ ছিল—মুসলমানের হাতে মুসলমান নিধন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকে পূর্ব বাংলার ইসলামকে কুসংস্কার ও লোকাচারের দ্বারা “দূষিত” মনে করত। গণমাধ্যম দাবি করে—শুধু “বিদ্রোহী” বা “বিচ্ছিন্নতাবাদীদের” টার্গেট করা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ যত এগোয়, সব সক্ষমদেহী বাঙালি পুরুষকেই সম্ভাব্য বিদ্রোহী হিসেবে ধরা হয়।
ভারতে পালাতে চাওয়া লোকজনকেও বিদ্রোহী ভাবা হত, যদিও অনেকেই শুধু যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে পালাচ্ছিলেন। সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হয় চুকনগরে—মে ১৯৭১-এ প্রায় ১০,০০০ শরণার্থী ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১০ মে—পুরো জনসমাবেশকে হত্যা করা হয়, নারী-শিশুসহ।
পশ্চিম পাকিস্তান মনে রেখেছিল—বাঙালি ভাষা ও পরিচয়কে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নেন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা। তাই তাঁদের পরিকল্পিতভাবে খুঁজে হত্যা করা হয়। উপন্যাসিক, নাট্যকার, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পীদের দলবদ্ধভাবে হত্যা করা হয়। বিজ্ঞান, আইন, অর্থনীতি ও চিকিৎসা-বিজ্ঞানের শিক্ষকরাও রেহাই পাননি। যুদ্ধ প্রায় হেরে যাওয়ার পরও সৈন্যরা ও সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা চালিয়ে যায়—ভাবতে যে এতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নেতৃত্বহীন হবে। কলেজ ছাত্ররাও একইভাবে লক্ষ্যবস্তু ছিলেন।
অধিকাংশ নিহত ছিলেন পুরুষ। অনেক ইতিহাসবিদ একে “জেন্ডারসাইড”—অর্থাৎ পুরুষনিধন—বলেন। তবে নারীরাও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। ২ থেকে ৪ লক্ষ বাঙালি নারী ধর্ষিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানের উগ্র ধর্মীয় নেতারা ঘোষণা দেন—“বিদ্রোহী” নারীরা সৈন্যদের জন্য “যুদ্ধলব্ধ সম্পদ”।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা যুদ্ধের শেষদিকে দেখেন—হাজার হাজার নারীকে “মিলিটারি ব্রোথেল”-এ আটকে রাখা হয়েছে। অনেককে জোরপূর্বক বিয়ে করা হয়েছে। যুদ্ধশেষে অসংখ্য নারী গর্ভবতী ছিলেন। ওই ধর্মীয় নেতারা বলেছিলেন—“ভাল মুসলিমের বীজে” তারা “ভাল প্রজন্ম” জন্ম দেবে। বাংলাদেশ তাদের “বীরাঙ্গনা” নামে সম্মান দেয়, যাতে সমাজে কলঙ্ক না লাগে।
মধ্য-১৯৭১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিতে “নির্বাচিত গণহত্যা” শব্দটি আসে। পরে শুধু “গণহত্যা” বলা হয়। আজও অনেকে অস্বীকার করেন—কারণ পুরো বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নয়, নির্দিষ্ট কয়েকটি শ্রেণীকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই শ্রেণীগুলো ছিল জনসংখ্যার বড় অংশ, এবং হত্যার মাত্রা আজকের আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্পষ্টতই “গণহত্যা”।
তাহলে কতজন নিহত? নিশ্চিত সংখ্যা নেই। ২১শ শতকেও নতুন গণকবর মিলছে। বাংলাদেশে “তিন মিলিয়ন” এখন জাতীয় বয়ানের অংশ। হয়তো সংখ্যা বেশি, যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের ২৬,০০০-এর সরকারি সংখ্যা অযৌক্তিকভাবে কম। যুদ্ধশেষে সিআইএ ২ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু অনুমান করে। আজও অনেকে সে সংখ্যা বলেন, কিন্তু তখনো জনমিতি–ভিত্তিক গবেষণা হয়নি, এবং নতুন নতুন কবরও মেলেনি। মার্কিন গবেষক রুডলফ জোসেফ রামেল নিহতের সংখ্যা ১৫ লক্ষ বলে অনুমান করেন।
বিহারি মুসলমানদের মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক আরও বেশি। তারা বিহার থেকে আসা উর্দুভাষী অভিবাসী, যারা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে গিয়ে ভয়ংকর মিলিশিয়া গঠন করেছিল। বিহারি সূত্র বলে—৫ লক্ষ নিহত, যা জনসংখ্যার হিসাবে অসম্ভব। প্রথম বাংলাদেশি সূত্র বলেছিল—১,০০০। বহু গবেষক ২০,000 হিসেবে ধরেছিলেন; রামেল বলেন—হতে পারে ১.৫ লক্ষ পর্যন্ত।
ভারতে পালানো শরণার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি নির্ভুল। ১৯৭১-এর মাঝামাঝি তারা ছিল ৬ মিলিয়ন; যুদ্ধশেষে ৮ মিলিয়ন। দেড় মিলিয়ন ভারতে থেকে যান, বাকিরা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফেরেন। শরণার্থীর এই ঢলই বিশ্বকে গণহত্যার বাস্তবতা বুঝতে বাধ্য করে।
বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৭ - হিন্দুধর্ম নিশ্চিহ্নের চেষ্টা
১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তান ও তাদের সহযোগীদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হিন্দু পুরুষদের হত্যা করে পুরো হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করা।
by Massimo Introvigne
পর্ব ৭/ ৮
বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, এবং পরে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার আন্দোলন—এসবই মূলত বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের নেতৃত্বে হয়েছিল। তবুও ১৯৭১-এর গণহত্যায় সবচেয়ে নিষ্ঠুর আঘাত আসে হিন্দুদের ওপর। পশ্চিম পাকিস্তানিরা হিন্দু হত্যায় থামেনি, এমনকি তাদের জেনারেলরা সতর্ক করেছিলেন—এতে ভারতীয় সেনা হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
এটি কোনো ভুল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের মতবাদে পূর্ব পাকিস্তানিরা “অশুদ্ধ” বা “খারাপ” মুসলমান—এর মূল ছিল তাদের ওপর “গোপন হিন্দু প্রভাব” থাকার অভিযোগ। বলা হত—হিন্দু সংস্কৃতির কারণে তাদের ইসলাম দুর্বল হয়েছে।
যুক্তি ছিল—পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা “অনেকটাই ধর্মীয়ভাবে উদাসীন,” এবং হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে থাকার প্রবল মনোভাব ছিল না। তাই “শুদ্ধ” মুসলমান বানাতে হলে—হিন্দুদের সরিয়ে দেওয়া দরকার।
পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলরাও জানতেন—পূর্ব পাকিস্তানের নয় মিলিয়নের বেশি হিন্দুকে সবাইকে হত্যা করা অসম্ভব। তবে তারা বিশ্বাস করত—একটা বড় অংশ হত্যা করলে বাকিরা ভারত পালাবে।
তা ঠিকই হয়েছিল। আট মিলিয়নের যে শরণার্থী ভারতে যায়—তার দুই-তৃতীয়াংশই ছিল হিন্দু। পশ্চিম পাকিস্তান বুঝতে পারেনি—এত বিশাল শরণার্থী প্রবাহের চাপ ভারতকেও যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।
১৯৭১-এ অস্বাভাবিক সংখ্যক হিন্দু নিহত হয়। তখন হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ২০%। কিন্তু অনুমান করা হয়—মোট নিহতের ৫০% পর্যন্ত হিন্দু হতে পারে। গণহত্যা বিশেষজ্ঞ আমেরিকান গবেষক রুডলফ জোসেফ রামেল লিখেছেন—পশ্চিম পাকিস্তানিরা ও তাদের মৌলবাদী সহযোগীদের চোখে “বাঙালি হিন্দুরা ছিল নাৎসিদের চোখে ইহুদিদের মতো—নিশ্চিহ্ন করার মতো বিষাক্ত প্রাণী।”
এই তুলনা আরও স্পষ্ট হয় কারণ পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিন্দুদের ঘরে হলুদ “H” চিহ্ন আঁকতে বাধ্য করত—যাতে সহজেই টার্গেট চিহ্নিত করা যায়।
তারা দাবি করত—হিন্দু নারীকে হত্যা করা হয় না, শুধু পুরুষদের। কিন্তু ভারতে যাত্রাপথের শরণার্থী দলগুলিতে হামলা হলে নারী-শিশুরাও মারা যেত। চুকনগরের ১০,০০০ নিহতের মতোই—২৩ এপ্রিল ১৯৭১-এ জাঠিভাঙায় প্রায় ৩,০০০ হিন্দু শরণার্থীকে হত্যা করা হয়।
গণহত্যার প্রথম দিকেই পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায়—শাঁখারি হিন্দুরা শাঁখা তৈরি করতেন। সেখানে ২০০-র বেশি পুরুষ–নারী–শিশুকে হত্যা করা হয়। অধিকাংশ হিন্দু নারীকে হত্যা না করে বরং ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করা হয়, পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া হয়, বা জোরপূর্বক বিয়ে করা হয়—যেমনটি মুসলিম বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রেও হয়েছিল।
কত হিন্দু নিহত হয়েছিল বা কত হিন্দু নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন—এটি সামগ্রিক গণহত্যা পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে। অনুমান—১ লক্ষ হিন্দু নারী ধর্ষিত এবং ৭ লক্ষ হিন্দু পুরুষ নিহত। তবে সঠিক সংখ্যা হয়তো আর জানা যাবে না।
হিন্দু মন্দির ও গ্রন্থাগারও আক্রমণ ও লুট করা হয়। এতে বহু অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ হারিয়ে যায়। ভয়ংকর উদাহরণ—ঢাকার রমনা কালী মন্দির ধ্বংস, যা মোগল আমল থেকে ছিল। মন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থিত আনন্দময়ী মা-র আশ্রমও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই হামলায় ৮৫ হিন্দু নিহত হন।
যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা ঘোষণার পর অধিকাংশ শরণার্থী বাংলাদেশে ফিরে আসে। তখন ঘোষণা করা হয়েছিল—ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগী মৌলবাদী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হবে।
তাদের আশা বেশিদিন টেকেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান “ধর্মনিরপেক্ষ ইসলাম”–এ বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫-এ তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে মৌলবাদী শক্তি আবার সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কন্যা হলেও, তাঁকেও নানা শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এর প্রমাণ—গণহত্যার ছায়া এখনো সমাজে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ গণহত্যা। পর্ব ৮ - বিশ্বের প্রতিবাদ, ভারতের হস্তক্ষেপ
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভারতের হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করে এবং যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়।
by Massimo Introvigne
পর্ব ৮/ ৮
আমার প্রজন্মের কাছে “বাংলা দেশ” প্রথমে ছিল জর্জ হ্যারিসনের (১৯৪৩–২০০১) একটি গান।
পরে ১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে তাঁর ও রবি শঙ্কর
(১৯২০–২০১২)-এর আয়োজিত কনসার্ট। যেখানে বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, ও এরিক
ক্ল্যাপটনের মতো তারকারা অংশ নিয়েছিলেন। হ্যারিসন ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের
মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে বিশ্বকে সচেতন করার দুই প্রধান মানুষের একজন। অন্যজন
ছিলেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮–১৯৮৬)। হ্যারিসনকে সবাই মনে রেখেছে,
মাসকারেনহাসকে অনেকেই ভুলে গেছেন। অথচ মাসকারেনহাস না থাকলে হ্যারিসনের কনসার্টও
হয়তো হতো না।
মাসকারেনহাস গোয়ান ক্যাথলিক। ছোটবেলায় পরিবার নিয়ে করাচিতে যান। তিনি সাংবাদিক
হন এবং মর্নিং নিউজ-এর সহকারী সম্পাদক। তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল
“শান্তি অভিযান” কভার করতে। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি দুটি সত্য বুঝে যান। এক—পশ্চিম
পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালাচ্ছে। দুই—এ কথা লিখলে পাকিস্তানের কোনো সংবাদপত্র
তা ছাপবে না।
তিনি করাচিতে থাকা স্ত্রীকে বলেন—শিশুদের নিয়ে দ্রুত লন্ডনে চলে যেতে। তারপর তিনি
লন্ডনের Sunday Times-এ যোগাযোগ করেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয় ১৩ জুন ১৯৭১-এ।
শিরোনাম ছিল সরল—“Genocide।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭–১৯৮৪) পরে জানান—মাসকারেনহাসের
প্রতিবেদনই তাঁকে সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় যে ভারতকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এরপর তিনি
ইউরোপ, রাশিয়া ও মস্কোয় কূটনৈতিক প্রচারণা চালান ভারতের সামরিক পদক্ষেপের পথ তৈরি
করতে। মাসকারেনহাস তখন নিরাপদে লন্ডনে। সেখানে তিনি দীর্ঘ ও সম্মানজনক সাংবাদিকতা
জীবনে প্রবেশ করেন।
ইন্দিরা ইউরোপ ও রাশিয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নয়। এই দুই
দেশ পাকিস্তানকে আঞ্চলিক মিত্র মনে করত, এবং সোভিয়েত-ঘনিষ্ঠ ভারতের বিরুদ্ধে
ভারসাম্য বলে দেখত। মার্কিন কূটনীতিকরা গণহত্যার খবর জানালেও প্রেসিডেন্ট রিচার্ড
নিক্সন (১৯১৩–১৯৯৪) ও হেনরি কিসিঞ্জার ভারতের পক্ষে কোনো ইঙ্গিত দিতে রাজি ছিলেন
না। বরং পাকিস্তানকে সহায়তার হুমকি দিয়েছিলেন।
নিক্সন ও কিসিঞ্জার ভেবেছিলেন—আমেরিকান জনগণ পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে খুব একটা
ভাবছে না। কিন্তু মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর রবি শঙ্কর জর্জ
হ্যারিসনকে তা দেখান। কনসার্ট শরণার্থী ও মানবিক সংকটে মনোযোগ দিয়েছিল, কিন্তু
হত্যাকারীরা কারা—তা অস্বীকারযোগ্য ছিল না।
১ আগস্ট কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। এটি রক ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়। ১৭ আগস্ট
সিনেটর টেড কেনেডি (১৯৩২–২০০৯), যাঁর নির্বাচকক্ষের অনেক হিন্দু নাগরিক ক্ষুব্ধ
ছিলেন, মার্কিন প্রশাসনের “গণহত্যা সমর্থনের” বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালান। এটি
আমেরিকার প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়।
কনসার্ট একাই সব বদলে দেয়নি। কিন্তু জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রভাব কম নয়। অনুষ্ঠানটি
দেখার পর বহু মাধ্যম বাধ্য হয় জানাতে—“বাংলাদেশ সংকট” আসলে কী। তারা গণহত্যার কঠোর
প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চাইলেও, শরৎ নাগাদ স্পষ্ট
হয়—ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ আমেরিকান ভোটারদের কাছে অত্যন্ত অজনপ্রিয়
হবে।
ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে—ভারত কি আরও আগে হস্তক্ষেপ করতে পারত? কারণ ভারত
সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেও গণহত্যা চলছিল। কিছু ডায়েরি অনুযায়ী—ইন্দিরা গান্ধী
এপ্রিলেই যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেলরা জানান—বর্ষাকালে আক্রমণ ঠিক
হবে না, প্রস্তুতির সময় লাগবে। ওই সময় ভারত মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও
সহায়তা দেয়।
নভেম্বরে ভারতের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে এখনও
সন্দেহ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে লোকজন ভারতবিরোধী জিহাদের দাবি তুলছিল—যেন কাশ্মীর
সমস্যাও একসাথে মিটে যায়।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান একটি গুরুতর ভুল করে—যেমন ১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হারবারে
করেছিল। বিকাল ৫:৪০-এ পাকিস্তানি বিমান বাহিনী “অপারেশন চেঙ্গিজ খান” শুরু
করে—উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ধ্বংস করা। তারা একসঙ্গে ১১টি ভারতীয়
ঘাঁটিতে আক্রমণ করে এবং কাশ্মীরে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। পাকিস্তান দাবি করেছিল—তারা
ইসরায়েলের “অপারেশন ফোকাস” থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু পাকিস্তানের বিমান শক্তি ছিল
দুর্বল। অনেক বোমাই বিস্ফোরিত হয়নি। অল্প কিছু ভারতীয় বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবুও এটি ছিল সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। ইন্দিরা গান্ধীর জন্য বিশ্বকে বলা সহজ হয়ে
উঠল—ভারত আক্রান্ত হয়েছে, তাই পাল্টা জবাব দিচ্ছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম
পাকিস্তানের ঘাঁটিতে হামলা চালায়। ভারতীয় সেনা, যারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পূর্ব
পাকিস্তানে ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছিল, দ্রুত অগ্রসর হয়ে দুই সপ্তাহের কম সময়ে
পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে। ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথ অবরোধ করে। ১৫ ডিসেম্বর
ঢাকা পতন হয়। ১৬ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল এ এ কে নিয়াজি (১৯১৫–২০০৪) লেফটেন্যান্ট
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার (১৯১৬–২০০৫) কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন।
ভারতে তখন দাবি উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু
১১ ডিসেম্বর মার্কিন পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ
বঙ্গোপসাগরে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর জবাবে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ ও
সাবমেরিন পাঠায়। চীনও সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে, কিন্তু সীমান্ত পেরোয়নি। ভারতও
সেখানে আটটি ডিভিশন প্রস্তুত রেখেছিল। কেউই বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ চাইছিল না।
ইন্দিরাও যুদ্ধ বাড়াতে চাননি। ২ জুলাই ১৯৭২ শিমলায় চুক্তি হয়—পাকিস্তান
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
যুদ্ধ ও গণহত্যা শেষ হয়। কিন্তু পরিণতি ছিল কঠিন। বিহারিদের মতো গোষ্ঠী—যারা
পাকিস্তানের পক্ষে ছিল—বাংলাদেশে নিপীড়িত হয়, বহু মানুষ নিহত হয়। সহযোগী
কয়েকজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারীরা কখনও বিচার
পায়নি।
ঘৃণা রয়ে যায়। বাংলাদেশে এখনো মৌলবাদীরা হিন্দু সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে সহিংসতা
চালায়। ১৯৭১-এর ইতিহাস বোঝা এবং জানানো—এই ধারাবাহিক লেখার উদ্দেশ্য ছিল সেটাই।